প্যালিওলিথিক যুগের পরেও বহুকাল আকাশ পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সুপ্রাচীন কালেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠে যে পুরাণ যদি এমন কোনো বাস্তবতার কথা বলে যা নিজেই বড্ড সর্বব্যাপী তবে সেই পুরাণ ব্যর্থ হতে বাধ্য। পুরাণ যদি মানুষকে ঐশ্বরিকতার সাথে কোনোভাবে শরিক করতে না পারে তবে তা তাদের চেতনা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে একটা পর্যায়ে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। কোনো একটা পর্যায়ে- আমরা জানি না ঠিক কখন ব্যাপারটা ঘটেছিল– পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠী আকাশের মাঝে মানবিক গুণাবলী আরোপ করতে শুরু করেছিল। তারা ‘আকাশ দেবতা’ বা ‘ঊর্ধ্বদেব’ এদের নিয়ে গল্প বলতে শুরু করে, যিনি একাকী শূন্য থেকে স্বর্গ আর মর্ত্য সৃষ্টি করেছেন। এই প্রাচীন একেশ্বরবাদ প্রায় নিশ্চিতরূপেই প্যালিওলিথিক পর্বের। অসংখ্য দেবদেবীর উপাসনা শুরু করার আগে, পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষ, কেবল একজন মহান ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিল যিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং দূর থেকে মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।
প্রায় প্রতিটি সর্বদেবতার মন্দিরের নিজস্ব আকাশ দেবতা রয়েছে। নৃতত্ত্ববিদেরা ফুজির আদিবাসী, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং পিগমীদের মতো জনগোষ্ঠীর মাঝে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন।[১০] সব বস্তুর তিনিই মূল / প্রথম কারণ এবং স্বর্গ ও মর্ত্যের শাসক। কোনো প্রতিমূর্তি বা প্রতিমা দ্বারা তাঁকে কখনও উপস্থাপন করা হয়নি এবং তাঁর কোনো পুরোহিত বা মন্দির নেই কারণ মানুষের প্রথাগত প্রার্থনায় তার প্রশংসা করা সম্ভব না। মানুষ ঊর্ধ্ব ঈশ্বরের প্রার্থনার সময় তাঁর প্রতি আকুল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে, বিশ্বাস করে যে তিনি উপর থেকে তাদের দেখছেন এবং খারাপ কাজ করলে শাস্তি দেবেন। কিন্তু তারপরেও তাদের প্রাত্যহিক জীবনে তিনি অনুপস্থিত। আদিবাসী মানুষদের ভাষায় তাঁকে প্রকাশ করা অসম্ভব এবং পৃথিবীর মানুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে তিনি ব্যগ্র নন। দুর্যোগের সময়ে তাঁরা তার স্মরণাপন্ন হতে পারে কিন্তু অন্য সময়ে তিনি অনুপস্থিত থাকেন এবং প্রায়শই বলা হয় ‘চলে গেছেন’ বা ‘অদৃশ্য হয়েছেন’।
প্রাচীন পারস্য, বৈদিক ভারত এবং গ্রীক ও ক্যানানাইটদের আকাশ ঈশ্বর এভাবেই বিলীন হয়ে গেছেন। এসব জনগোষ্ঠীর পুরাণ, ঊর্ধ্বঈশ্বর, বড়জোর একটা আবছায়া, শক্তিহীন দেবতা, সর্বদেবতার দিব্য উপস্থিতির মাঝে তাঁর অবস্থান খুব সাধারণ এবং ইন্দ্র, অনীল, বাআল এদের মতো প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয় আর অভিগম্যরাই সেখানে প্রাধান্য লাভ করেছে। ঊর্ধ্ব ঈশ্বর কিভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সেটা ব্যাখ্যা করে গল্প প্রচলিত আছে : যেমন, গ্রীকদের, আকাশ দেবতা ওরানস তার ক্ষমতা হরণ করে তারই ছেলে ক্রোনস, পুরাণে এসব নপুংসক স্রষ্টাদের খুব ভয়াবহভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যে তারা মানুষের প্রাত্যহিক জীবন থেকে দূরে এতটাই দূরে সরে গিয়েছে যে একটা সময়ে প্রান্তিক অবস্থার শিকার হয়েছেন। প্রতিবার বৃষ্টিপাতের সময়ে মানুষ বাআলের দিব্য ক্ষমতা অনুভব করে; যুদ্ধের সর্বব্যাপী চণ্ডতা তাদের যতবার আচ্ছন্ন করে ফেলে ততবারই ইন্দ্রের ক্ষমতা তাদের গোচরীভূত হয়। কিন্তু বুড়ো আকাশ দেবতা আর মানুষের জীবনকে সেভাবে ছুঁয়ে যায় না। এসব প্রাচীন লোককথা একটা বিষয় পরিষ্কার করে দেয় যে পুরাণ যদি খুব বেশিমাত্রায় আধিদৈবিক নির্ভর হয় তবে সেটা সফল হতে পারে না; মানবতার সাথে সম্পৃক্ত পুরাণই কেবল গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
আকাশদেবতার নিয়তি আমাদের আরেকটা ভ্রান্ত কিন্তু লোকপ্রিয় ধারণার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা প্রায়ই ধরে নেয়া হয় যে, প্রাচীন পুরাণসমূহ প্রাক বিজ্ঞান যুগে মানুষকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সূচনা সম্পর্কে অবহিত করতো। আকাশদেবতার গল্প ঠিক এধরনেরই অনুমানের কথা উপস্থাপন করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এটা একটা ব্যর্থ পুরাণ, মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে বা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কোনো সমস্যার সমাধানে এটা সাহায্য করতে অপারগ। আকাশ দেবতার দুর্দশাই আমাদের জন্য ব্যাখ্যা করাটা সহজ করে দেয় কেন মুসলমান, খ্রিস্টান আর ইহুদিদের উপাস্য স্রষ্টা ঈশ্বর, কেন পশ্চিমের বহু মানুষের জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পুরাণ কখনও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেয় না বরং এটা আচরণের একটা প্রাথমিক বিধিবিধান। আচরিত হলেই কেবল এর অন্তর্নিহিত সত্যটা প্রতিভাত হবে, তা সে নীতিগতভাবেই হোক বা প্রথাগতভাবেই হোক। এটাকে যদি কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো উপপ্রমেয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় তবে এটা বিরল, আর অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।
ঊর্ধ্বদেবতা হতে পারে মর্যাদা হারিয়েছে কিন্তু আকাশ আজও মানুষকে ঈশ্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পবিত্রতার পৌরাণিক প্রতীক হিসাবে উচ্চতা টিকে আছে– প্যালিওলিথিক আধ্যাত্মিকতার স্মারক হিসাবে। পুরাণ এবং মরমীবাদে নারী এবং পুরুষ উভয়েই আকাশকে ছুঁতে চেষ্টা করেছে এবং স্বপ্নযান এবং একাগ্রতার নানা তরিকা এবং পদ্ধতির জন্ম দিয়েছেন যাতে আরোহণের এই সমস্ত গল্পকে আচরিত পর্যায়ে নিয়ে এসে চেতনার উন্নততর ‘স্তরে’ ‘আরোহণ’ করা যায়। সাধুসন্তরা দাবী করেন যে দিব্য মণ্ডলে আরোহণের পূর্বে তারা দিব্য পৃথিবীর নানা স্তরের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করেছেন। বলা হয়ে থাকে যোগীরা শূন্যে ভেসে বেড়াতে পারে। মরমীবাদীরা দেহকে শূন্যে উত্থিত করতে পারে, নবীরা পাহাড় ডিঙিয়েছেন এবং অস্তিত্বের আরো মহত্তর মাত্রায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন।[১১] মানুষ যখন আকাশের সর্বব্যাপী বিস্তারের কারণে তার পানে ধাবিত হয়, তারা অনুভব করে যে মানুষেরা নশ্বরতা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে। সেই কারণে প্রায়শই পুরাণে পাহাড়কে পবিত্র জ্ঞান করা হয়েছে : স্বর্গ আর মর্ত্যের মধ্যবর্তী একটা স্থান, যেখানে মূসা (আঃ)-এঁর মতো লোকেরা তাদের ঈশ্বরের দেখা পান। সব সংস্কৃতিতেই আরোহণ সম্পর্কীয় পুরাণ লক্ষ্য করা যায়, সব কিছুকে অতিক্রম করার, ছাপিয়ে যাবার একটা বিশ্বজনীন আকাঙ্ক্ষা এবং মানব জন্মের নানা বন্ধন থেকে মুক্তি। পুরাণকে কখনও আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া উচিত না। আমরা যখন পড়ি যে যীশু খ্রিস্ট স্বর্গে আরোহণ করেছেন তখন বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে তিনি উঠে যাচ্ছেন কল্পনা করাটা আমাদের উচিত হবে না। মহানবী (সঃ) যখন মক্কা থেকে জেরুজালেমে উড়ে আসেন এবং তারপরে একটা সিঁড়ি বেয়ে আল্লাহ্র আরশে পৌঁছান, আমাদের বুঝতে হবে যে আধ্যাত্মিকতার একটা ভিন্ন উচ্চতর মাত্রায় তিনি আরোহণ করেছেন। নবী এলিজাহ্ (রা:) যখন আগুনের রথে চড়ে স্বর্গে আরোহণ করেন, তিনি মানুষের নশ্বরতা পিছনে ফেলে যান এবং পার্থিব অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে যে পবিত্র দিব্য অঞ্চল সেখানে পৌঁছান।