আমরা বর্তমানে ধর্মকে লোকায়ত থেকে আলাদা করে ফেলেছি। প্যালিওলিথিক শিকারীদের কাছে বিষয়টা অকল্পনীয় ছিল, যাদের কাছে লোকায়ত বা ইহজাগতিক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। তারা যা দেখতো বা অনুভব করতো সবই ছিল দিব্যজগতের স্বচ্ছ প্রতিমূর্তি। কোনোকিছু, তা সে যতই ইতর বা হীন হোক না কেন, পবিত্রতাকে ধারণ করতে পারতো। তাদের আচরিত সব কাজই ছিল অপসুদীক্ষার মতো যা তাদের দেবতাদের সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। বেশির ভাগ সাধারণ কর্মকাণ্ড ছিল আনুষ্ঠানিক যা নশ্বর আত্মাকে চিরন্তন পৃথিবীর সাথে একাত্ম হতে সাহায্য করতো।[৫] আমাদের মতো আধুনিকদের কাছে, কোনো প্রতীক বিমূর্ত বাস্তবতা থেকে স্বভাবতই আলাদা, যার প্রতি সেই প্রতীক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিন্তু গ্রীক symballein শব্দের মানে ‘একসাথে নিক্ষেপ করা’ : এখানে দুটো অসম বস্তুর অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠা বোঝানো হয়েছে– ঠিক যেমন ডিসপ্রিন পানিতে দ্রবীভূত হয়। তুমি যখন কোনো পার্থিব বস্তুর কথা গভীরভাবে চিন্তা করো, এর ঐশ্বরিক প্রতিরূপের উপস্থিতিতে তুমি সেটা করো। দিব্যতার সন্নিবেশের এই বোধটা পুরাণের বিশ্ব-বীক্ষার ক্ষেত্রে জরুরী : আধ্যাত্মিক মাত্রা সম্বন্ধে মানুষকে বেশি করে সজাগ করে তোলাটাই পুরাণের উদ্দেশ্য যে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে এবং জীবনের একটা স্বাভাবিক অংশ।
একেবারে প্রথমদিকের পুরাণগুলো মানুষকে পার্থিব জগতের মাঝ দিয়ে এমন একটা বাস্তবতা দেখাতে চাইতো যাতে মনে হবে অন্যকিছু একটা[৬] এর মধ্যে আরোপিত রয়েছে– কিন্তু এটা করতে বিশ্বাসের জোর দরকার হতো না কারণ এই পর্বে পবিত্র আর লোকায়তের মাঝে কোনো বিমূর্ত দূরত্ব বিরাজমান ছিল না। এসব প্রাচীন মানুষ যখন কোনো পাথরের দিকে দেখত, তারা সেটাকে কেবল অচেতন কোনো জড় পদার্থ বলে ভাবতো না। শক্তি, স্থায়িত্ব, একতা আর অস্তিত্বের একটা পরম মাত্রা হিসাবে পাথরটা প্রতিভাত হতো যা মানুষের ঘাতোপযোগী পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাথরের এই স্বতন্ত্রতাই তার পবিত্র বলে পরিগণিত হবার কারণ। পাথর কৃত্যানুষ্ঠানের একটা সাধারণ ধারক- পবিত্রতার বিস্ময়কর প্রকাশ প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্র। অথবা, একটা গাছ, যার অনায়াসে নিজেকে নবীন, পুনরুত্থিত করার শক্তি রয়েছে এবং দৃশ্যমান এই ক্ষমতা এক অলৌকিক প্রাণশক্তি মরণশীল নারী পুরুষের যাতে কোনো অধিকার নেই। চাঁদের ক্ষয় হওয়া যখন তারা দেখে, তখন পুনর্জন্মের পবিত্র উদাহরণ হিসাবে একে বিবেচনা করে,[৭] নিয়মের অলঙ্ঘনীয় নজির যা একাধারে কঠোর আবার করুণাময় এবং ভীতিকর আবার সেই সাথে প্রশান্তিদায়ক। গাছ, পাথর, কিংবা দিব্য সত্তা কখনও তাদের উপাসনার বস্তু ছিল না কিন্তু তাদের শ্রদ্ধা করা হতো কারণ তারা ছিল একটা গোপন শক্তির প্রকাশবার্তা যা সব প্রাকৃতিক বস্তুর ভিতর প্রচণ্ডভাবে প্রতিভাত হয়ে মানুষকে আরেকটা প্রভবিষ্ণু বাস্তবতার ইঙ্গিত প্রদান করতো।
সভ্যতার একেবারে শুরুর দিকের কিছু পুরাণ, যা সম্ভবত প্যালিওলিথিক যুগের চেয়েও প্রাচীন, আকাশের সাথে সম্বন্ধিত, যা মানুষকে সম্ভবত পবিত্রতার প্রথম ধারণা দিয়েছিল। তারা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো- তাদের ক্ষুদ্ৰ প্ৰাণ থেকে বহুদূরে অনন্ত অসীমে বিরাজমান– তাদের মনের ভিতরে একটা ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হতো।[৮] তাদের মাথার উপরে বিরাজমান প্রবল আকাশ, যার বিশালতা তাদের বোধগম্যতার অতীত এবং অনন্ত। সর্বব্যাপী আর স্বতন্ত্রতাইএর মূল নির্যাস। মানুষের পক্ষে এ দুটো জিনিসকে প্রভাবিত করা অসম্ভব। ঝড়, ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত, গ্রহণ, সূর্যাস্ত, রঙধনু এবং উল্কাপাতের শেষ না হওয়া নাটকই অন্য আরেকটা অনন্ত সক্রিয় যাত্রার কথা বলে যার নিজস্ব একটা গতিশীল জীবন রয়েছে। আকাশের কথা চিন্তা করে মানুষ কখনও হত ভীত কখনও আনন্দিত আবার কখনওবা আতঙ্কিত কখনওবা উদ্বিগ্ন। আকাশ কখনও তাদের আকর্ষণ করতো কখনও বীতস্পৃহা জন্মাত। রুডলক ওট্টো, ধর্মতত্ত্বের মহান ঐতিহাসিক বলেছেন, এর প্রকৃতিই ভয় ও শক্তির উদ্রেককারী। কোনো কল্পিত দেবীর অধিষ্ঠান ব্যতীত আকাশ নিজেই হলো mysterium tremendum terribile et fascinans?[৯]
পৌরাণিক ও ধর্মীয় চেতনা উভয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সাথে এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠি। আমাদের সন্দেহপ্রবণ বয়েসে, আমরা প্রায়শই ভেবে নিতাম মানুষ ধার্মিক কারণ তারা যে দেবতার আরাধনা করে তার কাছ থেকে তারা প্রতিদানে কিছু চায়। তারা চেষ্টা করে শক্তির বরাভয় যেন তাদের উপরেই বর্ষিত হয়। তারা চায় দীর্ঘ জীবন, রোগমুক্তি আর অমরত্ব এবং চিন্তা করে যে দেবতাকে তারা রাজি করাতে পারবে তাদের এসব বর প্রদানে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এইসব অতি প্রাচীন পৌরাণিক ব্যাখ্যায় আমরা দেখতে পাই উপাসনায় সব সময়ে নিজের বরাভয়ের উপলক্ষটা জরুরী না। মানুষ আকাশের কাছ থেকে কিছু চায় না এবং স্পষ্টতই জানতো কোনোভাবেই আকাশকে তারা প্রভাবিত করতে পারবে না। সুপ্রাচীন কাল থেকেই, আমরা পৃথিবীকে ভীষণ রহস্যময় হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত; ত্রাস আর বিস্ময়ের যুগলবন্দির সাহায্যে সে আমাদের আটকে রাখে যা কিনা আবার উপাসনার মূলসুর পরবর্তীকালে ইসরায়েলের জনগোষ্ঠী ঐশ্বরিক কিছু বোঝাতে qaddosh শব্দটা ব্যবহার করেছে। এর মানে ‘পৃথক, আলাদা’। শুদ্ধ ভাবোন্মাদনা নিজেই একটা সন্তুষ্টিকর অভিজ্ঞতা যা এমন কিছু সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে, যা তাদের আপন সত্তাকে পুরোপুরি ছাপিয়ে যেতে পারে, এবং তাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে অনুভূতি আর কল্পনার রাশ আলগা করে দিয়ে মানুষকে পরমানন্দের অভিজ্ঞতা এনে দেয়। এটা অচিন্তনীয় যে দুস্থ দুর্বল মানুষের ইচ্ছাকে আকাশ প্ররোচিত করতে পারবে।