এটা নতুন কিছু না। কোনো পুরাণের একটা অনুমোদিত বা স্বীকৃত ব্যাখ্যা কখনওই থাকে না। আমাদের পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে, আমাদের গল্পগুলোও ভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাদের মাঝে বিদ্যমান অনন্ত সত্যিকে অনুধাবনের খাতিরে। পুরাণতত্ত্বের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে, আমরা দেখব যে সামনের দিকে মানুষ যখনই বিশাল কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে তারা তাদের পুরাণতত্ত্ব পর্যালোচনা করেছে এবং নতুন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা তার কাছে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সেই সাথে আমরা আরও দেখব যে মানুষের প্রকৃতি আসলে খুব একটা বদলায় নাই এবং এসব পুরাণের অনেকগুলিই, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে কল্পিত যা আমাদের নিজেদের সমাজ থেকে খুব একটা আলাদা না, এখনও আমাদের সবচেয়ে অপরিহার্য চাহিদা আর ভয়ের কথাই বলে।
২. প্যালিওলিথিক যুগ : শিকারীদের পুরাণতত্ত্ব
(প্রায় ২০,০০০ বছর পূর্ব থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ সাল)
মানুষ তাদের ইতিহাসের এই পর্বে দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে গঠনমূলক জীববিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিবর্তন ক্রিয়া সম্পূর্ণ করে। নানা দিক থেকে বিবেচনা করলে এটা একটা ভীতিকর এবং উদ্বেগাকুল সময়। এইসব প্রাচীন মানুষের দল তখনও কৃষিকাজ আয়ত্ত করেনি। তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপন্ন করতে জানত না, জীবনধারণের জন্য তারা পুরোপুরি শিকার এবং খাদ্য সংগ্রহের উপরে নির্ভরশীল ছিল। শিকারের কৌশল আর আয়ুধের মতোই পুরাণও তাদের উত্তরজীবিতার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ছিল যা তারা, তাদের শিকার হত্যা করতে এবং তাদের পারিপার্শ্বিকের উপর এক প্রকারের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করেছিল। নিয়ানডারথালদের মতোই প্যালিওলিথিক নারী ও পুরুষ তাদের পুরাণের কোনো লিখিত বর্ণনা আমাদের জন্য রেখে যায়নি, কিন্তু এসব গল্প মানুষের নিজেদের বুঝতে, তাদের দুর্দশা অনুধাবন করতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে যে খণ্ডিতভাবে পরবর্তীকালের শিক্ষিত সংস্কৃতির পুরাণের অংশ হিসাবে এসব গল্প লিপিবদ্ধ হয়েছে। এইসব আদিম মানুষের অভিজ্ঞতা আর চিন্তাধারা, আমরা আফ্রিকার পিগমী বা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাপেরিজিনদের মতো দেশজ বা মাটির কাছের মানুষদের কাছ থেকে যারা প্যালিওলিথিক মানুষদের মতো শিকারী সমাজে বাস করে এবং কৃষিবিপ্লবের অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি, তাদের কাছ থেকে অনেকাংশে জানতে পারি।
প্রতীক ও পুরাণের আঙ্গিকে এসব দেশজ মানুষের চিন্তা করাটা স্বাভাবিক কারণ, নৃতত্ত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানীদের কল্যাণে আমরা জানতে পারি তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে দৈবের মাত্রা সম্বন্ধে খুব বেশিমাত্রায় সচেতন। শিল্পায়িত শহুরে সমাজের নারী পুরুষের জীবনে আমরা যাকে দিব্য অভিজ্ঞতা বলি সেটা এখন কল্পনায় পরিণত হয়েছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিকট এটা যে কেবল স্বতঃসিদ্ধ তাই না বস্তুজগতের চাইতে সেটা অনেক বেশি বাস্তব। ‘স্বপ্নসময়’ (dreamtime)– ঘুমের ভিতরে অস্ট্রেলিয়ানরা যা অনুভব করে এবং স্বপ্নাবির্ভাবের মুহূর্ত– সময়নিরপেক্ষ এবং ‘সতত’। আটপৌরে জীবনে এটা স্থায়ী প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি করে, মৃত্যু, দুর্দশাসহ অন্তহীন ঘটনার আনাগোনায় এবং ঋতুর পটপরিবর্তনে যা জর্জরিত। স্বপ্নসময়ে পূর্ব-পুরুষদের আনাগোনা–শক্তিশালী, অস্তিত্বের আদিরূপ যারা মানুষকে বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে যেমন শিকারের কৌশল, যুদ্ধের নীতি, বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া, কাপড় বয়ন এবং ঝুড়ি তৈরি। এসব কাজ, সেই কারণে, লৌকিক না বরং পবিত্র কর্মকাণ্ড যা নশ্বর নারী পুরুষকে স্বপ্নসময়ের সংস্পর্শে নিয়ে আসে। যেমন ধরা যাক, কোনো অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী যখন শিকার করতে যায়, প্রথম শিকারীর আচরণ সে এমনভাবে অনুসরণ করে তার প্রতিরূপ তৈরি করে যে সে নিজের মাঝে তাকে সম্পূর্ণভাবে অনুভব করে, পৃথিবীর শক্তিশালী আদিরূপের মাঝে সে যেন দ্রবীভূত হয়ে যায়। স্বপ্নসময়ের সাথে যখন সে এই প্রকার অতীন্দ্রিয় একাত্মতা অনুভব করে কেবল তখনই তার জীবনও যে অর্থবহ সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এর পরেই আদি বিশুদ্ধতা থেকে তার পতন ঘটে এবং সে তার বর্তমান সময়ে ফিরে আসে যা তাকে গ্রাস করে তার সমস্ত অর্জন নিমেষে বিনাশ করবে এই ভয়ে সে তখন অস্থির হয়ে উঠে।[৩]
আধ্যাত্মিক জগৎ এমন উপস্থায়ী আর তীব্র যে আদিবাসী মানুষেরা বিশ্বাস করে, এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষের অভিগম্যতা ছিল অনেক বেশি। প্রতিটি সংস্কৃতিতে আমরা হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ সম্বন্ধিত একটা পুরাণ দেখতে পাই, সেখানে মানুষ দিব্য সত্তার সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ আটপৌরে, জীবনযাপন করত। তারা ছিল অমর এবং প্রকৃতি আর তার পশুপাখির সাথে মিলেমিশে তারা শান্তিতে বসবাস করতো। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটা গাছ, পাহাড় বা খুঁটি, স্বর্গ আর মর্ত্যকে একসাথে জুড়ে রেখেছিল, যা বেয়ে মানুষ সহজেই দেবতার সন্নিকটে পৌঁছাতে পারত। তারপরে আসে এক ঘোর দুর্যোগ : পাহাড় বিচূর্ণ হয়, গাছ উপড়ে যায় এবং স্বর্গে পৌঁছানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে। স্বর্ণযুগের গল্প, খুব প্রাচীন এবং বিশ্বজনীন এক পুরাণ যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পবিত্রতার তীব্র অনুভূতি থেকে এর উৎপত্তি যা মানুষের সহজাত এবং বাস্তবতার অনুভূতি সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে যা প্রায় বাস্তব এবং আয়ত্তের সামান্য বাইরে। বেশির ভাগ প্রাচীন সমাজের ধর্ম এবং পুরাণ হারানো স্বর্গ ফিরে পাবার বাসনায় সিক্ত।[৪] যদিও পুরাণ নষ্টালজিয়ার সাধারণ কোনো কসরত না। পুরাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো কিভাবে আদর্শ পৃথিবীতে আবার ফিরে যাওয়া যায় মানুষকে সেই পথ দেখানো, দিব্যদৃষ্টির মগ্নতার মাধ্যমে না বরং তাদের প্রাত্যহিক জীবনের নৈমিত্তিক দায়িত্ব পালনের ভিতর দিয়ে।