১৯৩৯ সালের পূর্বের পৃথিবীর মাতাল অবস্থা উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কনসালের গ্রহণ করা প্রতি পাত্র মদ তাকে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেয়। কনসালের ন্যায়, মানবতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে এবং বিপদের দিকে ধেয়ে চলেছে। শেষ ইচ্ছার কাছে নত হয়ে জীবন আর অভিব্যক্তির ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলছে। কাবালাকে মরমী সাধকের সাথে তুলনা করা হয় যে মদ্যপের সাথে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। উপন্যাসের এটাই কেন্দ্ৰীয় ধারণা : ক্ষমতা হারানো জাদুকরের ন্যায় মানুষও এমন শক্তির অধিকারী হয়েছে যা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করে তবে থামবে। লোউরি আমাদের বোঝাতে চান তিনি এখানে পারমাণবিক বোমার কথা ভাবছেন। কিন্তু তারপরেও উপন্যাসটা নাস্তিবাদী না, মানবতার প্রেমময় উদ্ভটত্ব এবং সৌন্দর্য্য আর করুণরসের স্মৃতিচারণের মাঝে একটা গভীর সহমর্মিতার রেশ পাওয়া যায়।
আমরা দেখেছি যে পুরোপুরি লৌকিক প্রেক্ষাপটে কোনো পুরাণকে অনুধাবন করা সম্ভব না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে ভিন্ন বিধিবদ্ধ ছকেই কেবল একে বোঝা সম্ভব; নিজস্ব রূপান্তরের প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবে একে অনুভব করতে হবে। অবশ্য এর কিছুই উপন্যাসের প্রতি আরোপ করা যায় না, কোনো প্রকার আচার অনুষ্ঠানের বিধিবিধান ছাড়াই যে কোনো স্থানে এটা পাঠ করা যায় এবং অবশ্যই, যদি এতে কোনো লাভ হয়, প্রত্যক্ষ শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকে। তবু উপন্যাস পাঠের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা আমাদের পুরাণের সনাতন চেতনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ধ্যানের একটা রূপ হিসাবে একে দেখা যেতে পারে। কয়েকদিন বা সপ্তাহ পাঠক একটা উপন্যাসের সাথে বাস করে। এটা তাদের সমান্তরাল কিন্তু সাধারণ আটপৌরে জীবন থেকে আলাদা একটা জগতে নিয়ে যায়। তারা ভালোমতোই জানে এই কল্পিত জগৎ ‘সত্যি’ না কিন্তু পাঠ করার সময় সত্যি ভাবতে বাধ্য হয় তারা। শক্তিশালী কোনো উপন্যাস পাঠ শেষ করার অনেক পরেও সেটা আমাদের জীবনের প্রেক্ষাপটের একটা অংশে পরিণত হয়। এটা ভান করার একটা খেলা যা, যোগ ব্যায়াম বা ধর্মীয় উৎসবের ন্যায়, সময় এবং স্থানের বন্ধনী ভেঙে আমাদের সহানুভূতি উজ্জীবিত করে যার ফলে অন্যের জীবন তাদের দুঃখ আমরা অনুভব করতে পারি। এটা করুণা করতে শেখায়, অন্যের ‘সাথে অনুভব’ করার ক্ষমতা আমাদের শেখায়। এবং পুরাণের মতো, একটা ভালো উপন্যাসও রূপান্তর করার ক্ষমতা রাখে। আমরা যদি সুযোগ দেই তাহলে চিরতরে সে আমাদের বদলে দিতে পারে।
পৌরাণিক তত্ত্ব, আমরা দেখেছি, শিল্পকলার একটা মাধ্যম। যে কোনো শক্তিশালী শিল্পকর্ম আমাদের সত্তাকে জারিত করে এবং চিরতরে বদলে দেয়। বৃটিশ সমালোচক জর্জ স্টেইনার দাবী করেন যে চিত্রকলা, নির্দিষ্ট ধর্মীয় আর অধিবিদ্যামূলক অভিজ্ঞতার ন্যায়, সবচেয়ে “প্রবেশক্ষম,” রূপান্তরক্ষম মানুষের অভিজ্ঞতা যার শরণ নিতে পারে’। এটা উদ্বেধী, অধিক্রামক, অবিচারণা যা ‘আমাদের অস্তিত্বের শেষ নিভৃত স্থানের অনুসন্ধানে রত; একটা ঘোষণা যা আমাদের সতর্ক সত্তাকে ভেঙে ছোট ছোট ঘরে পরিণত করে,’ যাতে করে ‘পূর্বের ন্যায় একইভাবে এটা আর বাসযোগ্য না থাকে’। এটা একটা সর্বব্যাপী যোগাযোগ যা আমাদের বলে, আক্ষরিক অর্থে : ‘তোমার জীবনকে বদলে নাও’।[১০৮]
যদি গভীর মনোযোগ সহকারে এটা লেখা আর পড়া হয়, একটা উপন্যাস, পুরাণের ন্যায় বা শিল্পকলার অন্য যে কোনো মহান স্মারকের ন্যায়, প্রত্যুপক্রমে পরিণত হয় যা আমাদের সাহায্য করে জীবনের এক পর্যায় থেকে, মনের এক অবস্থা থেকে, যন্ত্রণাময় কৃত্যের দ্বারা অন্য স্তরে যেতে। উপন্যাস পুরাণের ন্যায়, পৃথিবীকে ভিন্ন চোখে দেখতে আমাদের শেখায়; এটা আমাদের শেখায় কিভাবে নিজের হৃদয়ে উঁকি দিতে হয় এবং এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথিবীকে দেখতে শেখায় যা আমাদের ব্যক্তিস্বার্থকে ছাপিয়ে যায়। যদি পেশাদার ধর্মীয় নেতারা পৌরাণিক বিদ্যায় আমাদের অবহিত করতে না পারে, তাহলে আমাদের লেখক আর চিত্রকরের দল হয়তো এই যাজকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত পথ হারানো পৃথিবীতে নতুন অন্তর্জ্জান নিয়ে আসতে পারে।
৮. তথ্যসূত্র
1 Mircea Eliade, The Myth of the Eternal Return or Cosmos and History (trans. Willard R. Trask, Princeton, 1994), passim.
2 J. Huizinger, Homo Ludens (trans. R.F.C. Hall, London), 1949, 5-25.
3 Huston Smith, The Illustrated World Religions, A Guide to our Wisdom Traditions (San Francisco, 1991), 235.
4 Mircea Eliade, Myths, Dreams and Mysteries. The Encounter between Contemporary Faiths and Archaic Realities (trans. philip Mairet, London, 1960), 59-60.
5 Ibid., 74.
6 Mircea Eliade, Patterns in Comparative Religion (trans. Rosemery Sheed, London, 1958), 216-19; 267-72.
7 Ibid., 156-8.
8 Eliade, Patterns in Comparative Religion, 38-58.
9 Rudolf Otto, The Idea of the Holy, An Inquiry into the non-rational factor in the idea of the divine and its relation to the rational (trans. John Harvey, Oxford, 1923), 5-41.