পুরাণ নির্মাতাদের মতো লেখক আর শিল্পী দলের মাঝে একই মাত্রার বোধ কাজ করায়, সহজাতভাবেই তারা একই ধরনের ভাবধারার সহায়তা নেয়। জোসেফ কনরাডের Heart of Darkness কে একটা বীরোচিত অভিযাত্রা আর দীক্ষা হিসাবে দেখা যেতে পারে যা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯০২ সালে প্রকাশিত, পশ্চিমের মোহভঙ্গ শুরু হবার ঠিক আগে, উপন্যাসটা আফ্রিকার গহীন বনে অতি-সভ্য মি. কার্টজের কিছুকাল অবস্থানের বর্ণনা। সনাতন পুরাণে, সামাজিক পৃথিবীর নিরাপত্তা পেছনে রেখে নায়ক এগিয়ে যায়। কখনও তাকে পাতালে নামতে হলে, সেখানে তার সাথে হয়তো নিজের অশঙ্কিত সত্তার দেখা হয়। বিচ্ছিন্নতা আর বঞ্চনার অভিজ্ঞতা থেকে স্নায়বিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে, যা জীবনীয় অন্তর্জানের পথে নিয়ে যাবে। সে সফল হলে, নায়ক নতুন আর মূল্যবান কিছু একটা নিয়ে নিজের লোকের কাছে ফিরে আসে। কনরাডের উপন্যাসের সর্পিল অপকারী আফ্রিকার নদী আমাদের লাসাক্সের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের কথা মনে করিয়ে দেয়, যার মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে সম্ভাব্য সদস্য পৃথিবীর জঠরে ফিরে যায়। পাতালপুরীর আদিমতম জঙ্গলে, কার্টজ সত্যিই নিজের হৃদয়ের কলুষতায় উঁকি দেয়, কিন্তু নিজের প্রত্যাবৃত্তি অব্যাহত রাখে এবং আধ্যাত্মিকতায় অবগাহন করেই মারা যায়। সে একজন শামান, মানব-এ পরিণত হয় যার হৃদয়ে আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই কেবল ক্ষোভ রয়েছে যাদের উপরে সে অত্যাচার করে। পৌরাণিক নায়ক জানতে পারে যে, সে যদি নিজের সত্তাকে হত্যা করে, নতুন জীবনে তার পুনর্জন্ম হবে; কিন্তু কার্টজ বন্ধ্যা আত্মপ্রচারের ফাঁদে আটকে যায়, উপন্যাসে যখন সে শেষ পর্যন্ত এই ফাঁদ থেকে বের হয়, সে তখন সজীব শবদেহের অশ্লীলতায় পরিণত হয়েছে। নিজের খ্যাতির মোহে অন্ধ, কার্টজ বীরত্বের বদলে বন্ধ্যা খ্যাতি বেছে নেয়। জীবনের বীরোচিত প্রত্যয় ব্যক্ত করতে সে ব্যর্থ হয় : তার অন্তিম কথা ‘বিভীষিকা! কি বিভীষিকা!” কার্টজের অন্তিম বাক্যকে টি.এস. এলিয়ট The waste Land-এর এপিগ্রাফ করেছেন। কনরাড, সত্যিকারের এক দৈবজ্ঞ, বিংশ শতাব্দীর স্বার্থপরতা, লোভ, নাস্তিবাদ, হতাশা আর অকিঞ্চিৎকরতা সম্বন্ধে আমাদের জানিয়ে রেখেছেন।
টমাস মান তার The Magic Mountain উপন্যাসেও দীক্ষাদানের এই মোটিফ ব্যবহার করেছেন (১৯২৪), পশ্চিমা ইতিহাসের আরেক সন্ধিক্ষণে যা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি স্বীকার করেছেন যে তার আসল উদ্দেশ্য এটা ছিল না, কিন্তু হার্ভাডের এক তরুণ ছাত্র যখন তাকে বলে যে “The Quester Hero’ এর আধুনিক উদাহরণ এটা, সে সাথে সাথে অনুধাবন করে যে আসলেও তাই ঘটেছে। বীরোচিত অভিযানের পুরাণ তার অবচেতনে প্রোথিত ছিল এবং না বুঝেই তিনি এর উপরে নির্মাণ শুরু করেন যা তিনি করেছেন। মানের উপন্যাসের ডাভোস আরোগ্য নিকেতন পরিণত হয় ‘দীক্ষাদানের আচার অনুষ্ঠানের মন্দিরে, জীবনের রহস্যময়তা সম্বন্ধে রোমাঞ্চভিলাষী অনুসন্ধানের স্থান’। হানস কাস্ট্রপ, তার নায়ক, হলি গ্রেইলের সন্ধানী, ‘জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর পবিত্রতার’ স্মারক জীবনকে যা অর্থবহ করে তোলে। কাস্ট্রপ ‘স্বেচ্ছায় রোগ আর মৃত্যুকে বরণ করেন কারণ তাদের সাথে তার প্রথম যোগাযোগেই তারা তাকে অসাধারণ অগ্রগতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অবশ্য এর সাথে বিশাল ঝুঁকিও রয়েছে’। আর তারপরেও, এই আধুনিক দীক্ষাদান একই সাথে বিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান তুচ্ছতাকে ধারণ করে। আরোগ্য নিকেতনের রোগীদের মাঝে মানব ‘বিচ্ছিন্নতা আর ব্যক্তিবাদের একটা মনোহর চক্র’ তৈরি হতে দেখেন সনাতনের সন্ধানীরা যেখানে নিজের সমাজের মঙ্গল সাধন করতে চায় সেখানে কাস্ট্রপ মগ্ন থাকে এক আত্মকেন্দ্রিক, পরজীবী আর চূড়ান্তভাবে লক্ষ্যহীন সাধনায়।[১০৭] তার মায়াবী পাহাড়ে সে সাত বছর কাটায়, মানবতার জন্য নিজের মহান স্বপ্নগুলোর কথা ভাবে, কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাবার জন্য, যাকে ইউরোপের সম্মিলিত আত্মহনন বলে অভিহিত করা চলে।
ম্যালকম লোউরির Under the Volcan (১৯৪৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে মেক্সিকোর প্রেক্ষাপটে রচিত। কনসাল, এক পাড় মদ্যপের, জীবনের শেষ দিনটার সন্ধান করে, যে কিনা লোউরিরই কেবল না কিন্তু- সেটা পরিষ্কার বোঝানো হয়- আমাদের সবার আত্মস্বরূপ। বইটার শুরু ক্যান্টিনা ডেল বসকে, দান্তের ইনফার্নোর ‘গহীন অরণ্যের কথা স্মরণ করায়, ডে অব দ্য ডেডে, যখন মৃতেরা বিশ্বাস করা হয় যে, জীবিতদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। পুরো উপন্যাসে, লোউরি প্রাচীন পৌরাণিক অন্তজ্ঞান যা বলে জীবন আর মৃত্যু অচ্ছেদ্য তার অনুসন্ধান করেছেন। উপন্যাসে মেক্সিকোর ভূ-প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের আর প্রাণবন্ত জীবনের- যেন একটা স্বর্গোদ্যান- বর্ণনার পাশাপাশি মৃত্যু আর অন্ধকারের নারকীয় চিত্রকল্পের অবতারণা করা হয়েছে। আপাত তুচ্ছ বর্ণনা বিশ্বজনীন দ্যোতনা লাভ করেছে।
যুদ্ধ উপদ্রুতদের মতো যারা বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষাকারী বাঙ্কারে আত্মগোপন করে, তাদের মতো মানুষ ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেয়; সিনেমা হলের আলো নিভে যায় ঠিক যেমন ইউরোপে আধার নেমে এসেছিল সেভাবে। চলচ্চিত্রটার জন্য নির্মিত বিজ্ঞাপন Las Manos de Orlac, সাথে রক্ত রঞ্জিত হাড়, মানবতায় সম্মিলিত অপরাধবোধের কথাই মনে পড়িয়ে দেয়; একটা নাগরদোলা সময়ের বহমানতা প্রকাশ করে; রাস্তার পাশে মৃতাপন্ন কৃষক মনে করিয়ে দেয় পৃথিবী জুড়ে মানুষ অযত্ন অবহেলায় মারা যাচ্ছে। কনসাল ক্রমশ উন্মাদ হয়ে উঠলে, তার চারপাশ একটা ভ্রমোৎপাদক তীব্রতা লাভ করে যেখানে বস্তু আর ঘটনার অস্তিত্ব একে অপরকে ছাপিয়ে যায়। প্রাচীন পুরাণে সবকিছুরই ঐশ্বরিক গুরুত্ব ছিল এবং কোনো একটা বস্তু বা কর্মকাণ্ড লৌকিক ছিল না। লোউরির উপন্যাসের ডে অব দ্য ডেডের সময় গড়িয়ে চললে, কিছুই নিরপেক্ষ থাকে না : সবকিছুতেই নিয়তি নির্ধারিত গুরুত্ব আরোপিত হয়।