ইলিয়টের কবিতাটা ছিল ভাবীসূচক। ধর্মীয় নেতাদের চাইতে লেখক আর শিল্পীর দলই শূন্যতায় অবগাহন করে আমাদের অতীতের পৌরাণিক প্রজ্ঞার সাথে পুনরায় পরিচয় করাতে চেষ্টা করেছে। তাদের আধুনিকতার হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা আর বন্ধ্যাত্বের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক খুঁজে পাবার প্রচেষ্টায় অনেকেই যেমন চিত্রশিল্পীদের কথাই ধরা যাক, পৌরাণিক ভাবধারায় মনোনিবেশ করেছেন। ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল, স্পেনের গৃহযুদ্ধ যখন তুমুল আকার ধারণ করেছে, নাজী যুদ্ধবিমান, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সরাসরি নির্দেশে বাসক রাজধানী গুয়েরনিকায় হাটবারে আক্রমণ করে, এর ৭০০০ অধিবাসীর ১৬৫৪ জনকে হত্যা করে। কয়েক মাস পরে, প্যারিসে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসো তার গুয়েরনিকা চিত্রকর্মটি প্রদর্শিত করেন। এই আধুনিক লোকায়ত ক্রুশবিদ্ধকরণ তার সমসাময়িকদের চমকে দেয় এবং The waste Land-এর মতো এটাও ছিল ভাবীসূচক একটা বক্তব্য এবং নতুন বিশ্বের কাছে এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে নব জাগরণের প্রয়াস।
চিত্রকর্মটা ছিল করুণাঋদ্ধ, অন্যের যন্ত্রণা অনুভব করার ক্ষমতাযুক্ত। প্রাচীন পৌরাণিক নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় উৎসর্গ একটা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। প্যালিওলিথিক সময়ে মানুষ যেসব পশু শিকার এবং হত্যা করতো তারা তাদের প্রতি এক ধরনের যন্ত্রণাদায়ক স্বভাবগত সাযুজ্য অনুভব করতো। উৎসবের আচার অনুষ্ঠানে তারা তাদের এই অপরিণত দুর্দশা ব্যক্ত করতো যা মানবতার খাতিরে হত হওয়া সেই জন্তুকে সম্মান জানাত। গুয়েরনিকায়, মানুষ আর পশু উভয়েই এলোপাথাড়ি বাছবিচারহীন হত্যাযজ্ঞের শিকার, তালগোল পাকিয়ে একটা স্তূপের ন্যায় পড়ে আছে, যন্ত্রণায় অস্থির ঘোড়া অনিস্তার্যভাবে কবন্ধ শবের সাথে জড়িয়ে যায়। যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার অগণিত চিত্রে ক্রুশের পায়ের কাছের রমণীদের কথা মনে করিয়ে দেয়, দুই মহিলার চোখে আহত ঘোড়ার যন্ত্রণার সাথে বিষাদঘন একাত্মতা। প্রাগৈতিহাসিক সমাজে মহান মাতা একজন অপ্রশম্য শিকারী, কিন্তু পিকাসোর চিত্রকর্মে, মা তার মৃত সন্তানের নিস্তেজ শরীর জড়িয়ে আছে, নিজেই উপদ্রুত হয়ে নির্বাক আর্তনাদে মুখরিত। তার পেছনেই একটা মোষ, যা পিকাসো বলেন, নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক। বুলফাইটের দর্শনীয় আচারঅনুষ্ঠান সবসময়েই পিকাসোকে মুগ্ধ করেছে, স্পেনের এই জাতীয় খেলার যোগ আছে অতীতের উৎসর্গের আনুষ্ঠানিকতার সাথে। পিকাসোর মোষ দেখতে নির্মম না; অন্যান্য উপদ্রুতদের সাথে সে দাঁড়িয়ে, লেজ আছড়ায় আর দৃশ্যপট জরিপ করে। হয়তো এটাই বোঝাতে চায় সে বুলফাইটের সেই মুহূর্তে সে পৌঁছে গেছে যখন সে আক্রমণ বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ চিন্তা করছে। কিন্তু নিজেই বলির শিকার হবার কারণে, নিষ্ঠুরতার প্রতীক, মোষের ধ্বংস অনিবার্য। আর তাই- পিকাসোও হয়তো বলতে চান– আধুনিক মানবতাও তাই যা– যদিও পিকাসোর পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না- যৌক্তিকভাবে নিরূপিত হিংসা আর আত্মনাশী প্রবণতার পূর্ণ সম্ভাবনা সবেমাত্রই খোঁজ করতে শুরু করেছে।
উপন্যাস লিখিয়ের দলও আধুনিকতার দুর্দশা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পুরাণের দ্বারস্থ হয়েছেন। The Waste Land-এর সাথে একই বছর প্রকাশিত জেমস জয়েসের ইউলিসিসের কথা আমাদের ভাবা উচিত, যেখানে রয়েছে হোমারের ওডেসির বিভিন্ন অধ্যায়ের সাথে জয়েসের সমসাময়িক মুখ্য চরিত্রদের অভিজ্ঞতার একটা সঙ্গতিপূর্ণ বর্ণনা। মায়াবী বাস্তববাদীর দল- হোর্হে লুইস বোর্হেস, গুন্টার গ্রাস, ইটালো ক্যালভিনো, অ্যানজেলা কার্টার, সালমান রুশদী- লোগোসের আধিপত্যের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন অব্যক্তের সাথে বাস্তবতাকে জুড়ে দিয়ে এবং রূপকথা আর স্বপ্নের পৌরাণিক যুক্তির দ্বারা আটপৌরে যুক্তির বিন্যাসকে একত্রিত করে। অন্য লেখকরা ভবিষ্যতের দিকে চোখ মেলেছেন। জর্জ অরওয়েলের Nineteen Eighty Four (১৯৪৯) পুলিশী রাষ্ট্রের বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দেয় যেখানে জোর যার মুল্লুক তার আর বর্তমানের সাথে খাপ খাওয়াবার জন্য অতীতকে ক্রমাগত বদলানো হয়। অরওয়েলের বক্তব্যের যথাযথ ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রচুর তর্ক হয়েছে কিন্তু অতীতের মহান পুরাণের ন্যায়, এটা লৌকিক চেতনার প্রকাশ করেছে। উপন্যাসটার অনেক বাক্য আর দৃশ্যকল্প আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় প্রবেশ করেছে : বিগ ব্রাদার, ডবলথিঙ্ক, নিউজস্পেক, এবং রুম ১০১ এখনও ব্যবহৃত হয় ধারা চিহ্নিত করতে এবং আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট্যাবলী বোঝাতে, উপন্যাসটা যারা পড়েনি এমনকি তারাও এগুলো ব্যবহার করে।
কিন্তু লোকায়ত একটা উপন্যাস কি সত্যিই সনাতন পুরাণের পুনরাবৃত্তি করতে পারে, যেখানে দেবতা আর দেবীরা থাকবে? প্রাক আধুনিক পৃথিবীতে আমরা দেখেছি যে, পশ্চিমা লোগোসের দ্বারা আরোপিত অধিবিদ্যামূলক ধারণার শব্দ দ্বারা খুব কমই ঐশ্বরিকতাকে বোঝানো হতো কিন্তু মানুষকে তাদের মানবতা বোঝাতে যা সাধারণত সাহায্য করে। মানুষের অবস্থা বদলাবার সাথে সাথে, দেবতারা অনেক সময় অপসৃত হয়ে পুরাণে এবং ধর্মে একটা প্রান্তিক স্থান নেয়; কখনও অবশ্য একেবারেই হারিয়ে যায়। সমসাময়িক উপন্যাসের দেবতাহীন পুরাণে নতুন কিছু নেই যা প্রাচীন পুরাণের ন্যায় মানুষের অবস্থার একই ধরনের বিস্মৃতিপ্রবণ আর দুর্দম সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে এবং আমাদের উপলব্ধি করায় যে- কেবল দেহটা নিয়েই মানুষের অস্তিত্ব না এবং সবারই দিব্য ঐশ্বরিক মূল্য রয়েছে।