আমরা হয়তো বৈষয়িক দিকে অনেক বেশি পরিশীলিত হয়েছি, কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে আমরা এখনও অ্যাক্সিয়াল যুগের ঊর্ধ্বে যেতে পারিনিঃ মিথোসের অবদমনের ফলে হয়তো আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। আমাদের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের ‘ঊর্ধ্বে’ উঠতে এবং ‘পুরোপুরি’ আরও প্রবল, পরিপূর্ণ অস্তিত্বে প্রবেশ করতে দেরি আছে। চিত্রকলা, মাদকদ্রব্য, রক সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের জীবনের চেয়ে বড় দৃষ্টরূপে প্রবেশ করে আমরা এই মাত্রায় বিলীন হতে চাই। আমরা আজও বীরের পূজারী। প্রিন্সেস ডায়ানা আর এলভিস প্রিসলী তাই সাথে সাথে পৌরাণিক সত্তায় পরিণত হয় এমনকি ধর্মীয় প্রার্থনাসভার কাল্টের বিষয়ে পরিণত হয়। বীরের পুরাণ আমাদের শ্রদ্ধার স্মারক সরবরাহ করবে সেটা অভিপ্রেত না কিন্তু বীরত্বের শোণিত ধারা আমাদের মাঝে সঞ্চারিত করবে সে লক্ষ্যে পরিকল্পিত। অপ্রতিরোধী বিবেচনা না অংশগ্রহণ বা সীমিতকরণের দিকে পুরাণকে অবশ্যই পথ দেখাতে হবে। আমরা আজ জানি না কিভাবে আমাদের পৌরাণিক জীবনকে বশে আনতে পারি এমনভাবে যা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং রূপান্তরযোগ্য।
পুরাণ মিথ্যা বা চিন্তাধারার নিকৃষ্টতম ধরনের উপস্থাপক ঊনবিংশ শতকের ভ্রান্তির এই মায়াজাল থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমরা আমাদের পুরোপুরি পুনর্গঠন করতে পারব না, আমাদের শিক্ষার যৌক্তিক দুর্বলতা নাকচ করে প্রাক আধুনিক সুকুমার আবেগ, সংবেদনশীলতায় ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে আর সম্ভব না। কিন্তু পৌরাণিক তত্ত্বের প্রতি আমরা অনেক পরিশীলিত মনোভাব অর্জন করতে পারি। আমরা পুরাণ সৃষ্টিকারী প্রাণী এবং বিংশ শতাব্দী জুড়ে আমরা কিছু অতীব ধ্বংসাত্মক আধুনিক পুরাণ দেখেছি, যার শেষ হয়েছে রক্তপাত আর গণহত্যার ভিতর দিয়ে। অ্যাক্সিয়াল যুগের বৈশিষ্ট্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় এসব পুরাণ ব্যর্থ হয়েছে। সহানুভূতিশীলতা, সব জীবনই মূল্যবান বা কনফুসিয়াস যাকে বলেছিলেন ‘Leaning’ তার প্রতি কোনো প্রকার ভক্তি এসব গুণাবলী আধুনিক পুরাণে সঞ্চারিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এসব ধ্বংসাত্মক পুরাণ সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের বিভক্তি দ্বারা অভিযুক্ত আর অন্যদের আসুরিকভাবে দমন করে নিজের আত্মপ্রচারের একটা স্বার্থপর প্রচেষ্টা। এমনসব পুরাণের কারণেই আধুনিকতা ব্যর্থ হয়েছে, যা একটা বিশ্ব বসতি তৈরি করেছে যেখানে প্রতিটা মানুষ আজ নিজেদের একই ধরনের বিপাকে দেখতে পাচ্ছে। কেবল যুক্তির দ্বারা এসব পুরাণকে পরাস্ত করা সম্ভব না কারণ এ ধরনের সুদূরপ্রসারিত, মন্ত্রপূত ভয়, আকাঙ্ক্ষা এবং স্নায়বিক বৈকল্যকে কেবলমাত্র আনাড়ি লোগোসের দ্বারা দূর করা সম্ভব না। আধ্যাত্মিক আর নৈতিকভাবে পুষ্ট পুরাণের কাজ সেটা।
আজ আমাদের এমন পুরাণ প্রয়োজন যা অন্য সব মানুষের সাথে নিজেদের চিহ্নিত করতে আমাদের সহায়তা করবে, যারা আমাদের জাতীয়, আদর্শগত বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত না। করুণার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে এমন পুরাণ আজ আমাদের প্রয়োজন যাকে আমাদের যৌক্তিক প্রয়োগবাদী পৃথিবীতে দক্ষ বা যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদনশীল হিসাবে গণ্য করা হয় না। আমাদের আশু প্রয়োজনকে ছাপিয়ে দেখতে সাহায্য করে এমন আধ্যাত্মিক মনোভাব গড়ে তুলবে আমাদের আজ সেই পুরাণ দরকার এবং আমাদের পরিশীলিত স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে প্রশ্নের আঙ্গুল তুলবে যা আমাদের একটা সর্বব্যাপী বোধ অনুভবে সাহায্য করবে। কেবল তার ‘সম্পদ’ ব্যবহার না করে, পৃথিবীকে ঐশ্বরিক হিসাবে আমাদের আরো একবার সম্মান করতে শেখাবে, এমন পুরাণ আজ প্রয়োজন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোনো ধরনের আধ্যাত্মিক বিপ্লব, যা আমাদের প্রযুক্তিগত প্রতিভার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম, না হলে, আমরা আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে পারব না।
১৯২২ সালে, টি.এস. এলিয়ট তার বিখ্যাত কবিতা The Waste Land-এ পশ্চিমা সংস্কৃতির এই আধ্যাত্মিক বিখণ্ডায়ন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। Holy Grail- এর পুরাণে, ওয়েস্টল্যাণ্ডের লোকেরা কৃত্রিম জীবনযাপন করে, কোনোপ্রকার বিশ্বাস ছাড়া অন্ধভাবে সমাজের রীতিনীতি অনুসরণ করে গভীর অনুকম্পা থেকে যার উৎপত্তি। নিজের সংস্কৃতির পৌরাণিক ভিত্তির পরশ যেখানে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে সেখানে কি আধুনিকতার ‘পাথুরে জঞ্জালে’ সৃষ্টিশীলতার মূল প্রোথিত করা সম্ভব? নিজেদের রীতিনীতির অন্তর্নিহিত প্রাঞ্জলতা অনুধাবনের পরিবর্তে তারা জানে কেবল ‘ভাঙ্গা প্রতিমার এক ঢেলা’। অতীতের পুরাণের মর্মভেদী যথাযথ উল্লেখের সাহায্যে- ইউরোপীয়, সংস্কৃত, বৌদ্ধ, বাইবেলীয়, গ্রীক আর রোমান পুরাণ- আধুনিক জীবনের বন্ধ্যাত্বকে প্রকাশ করেন এলিয়ট; এর বিচ্ছিন্নতাবোধ, অবসাদ, বিষণ্ণতা, নাস্তিবাদী, কুসংস্কার, হতাশা আর আত্মপ্রচার। পশ্চিমা সভ্যতার আশু বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তার কথক উপসংহার টানে : ‘আমার ধ্বংসের মাঝে এসব টুকরো আমি বিলিয়ে দিলাম।’ অতীতের অন্তর্দৃষ্টির এই খণ্ডিতাংশ যা এই কবিতায় তিনি একত্রিত করেছেন আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। এই টুকরোগুলোকে একত্রিত করে আমরা তাদের সাধারণ নির্যাসটুকু যদি অনুধাবন করতে পারি, আমরা আমাদের ওয়েস্টল্যাণ্ড যেখানে আমরা বাস করতাম পুনরুদ্ধার করতে পারব।