বৈজ্ঞানিক লোগোস আর পুরাণ ক্রমশ পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠছে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান পুরাণের বিভিন্ন অংশের মাঝে পরিচালিত হয়েছে যা এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে। ফরাসী গণিতবিদ রেইসী প্যাসকেল (১৬২৩-৬২) ছিলেন পরম ধার্মিক একজন মানুষ, যখন তিনি অনন্ত বিশ্বের ‘চিরন্তন নিরবতা, আধুনিক বিজ্ঞান যা উন্মুক্ত করেছে, বিবেচনা করেন তার মন আতঙ্কিত হয়ে উঠে।
মানুষের অন্ধ দুর্দশাময় অবস্থা আমি যখন দেখি, সমগ্র বিশ্বকে আমি যখন এর নিরবতার মাঝে পর্যবেক্ষণ করি, এবং আলো ছাড়া মানুষ একাকী পড়ে রয়েছে যেন বিশ্বের এই কোণে সে হারিয়ে গেছে জানেও না কে তাকে এখানে স্থাপন করেছে, কি তার করণীয়, বা মারা গেলে তার কি হবে, কোনো কিছু জানতে অক্ষম, আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি, সেই মানুষের মতো ঘুমের মাঝে যাকে কোনো ভয়ংকর নিঃসঙ্গ দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়েছে, পালাবার পথ বিচ্ছিন্ন এই একটা অনুভূতি নিয়ে যে জেগে উঠেছে। তারপরে আমি বিস্মিত হই, এত দুর্দশাপূর্ণ অবস্থাতেও মানুষকে হতাশ না হতে দেখে।[১০৩]
এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ আধুনিক অভিজ্ঞতারও অংশ।
অষ্টাদশ শতকের যুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশের কালে এই মেঘ কিছুটা দূর হয়েছিল বলে মনে হয়। জন লক (১৬৩২-১৭০৪) অনুধাবন করেন যে দিব্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না, এবং বিশ্বাস করতেন মানবতা একটা গঠনমূলক যুগে প্রবেশ করেছে। আলোকপ্রাপ্ত ফরাসী আর জার্মান দার্শনিকের দল পুরাতন মরমীবাদ আর পৌরাণিক ধর্মকে বাতিল হিসাবে দেখতেন। বৃটিশ ধর্মবেত্তা জন টোল্যান্ড (১৬৭০-১৭২২) আর ম্যাথিউ টিনডালও (১৬৫৫-১৭৩৩) একই মত পোষণ করতেন। সত্যের সন্ধান কেবল লোগোস দিতে পারে এবং মরমীতত্ত্ব আর পৌরাণিকতার নিগড় থেকে খ্রিস্টান ধর্মকে মুক্ত হতে হবে। পুরাতন পুরাণগুলোকে, সেগুলো যেন লোগোই (Logoi) এভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু হয়, একটা সম্পূর্ণ নতুন ধারা ব্যর্থতা তার নিয়তি, কারণ এসব গল্প কখনও বস্তুনিষ্ঠ ছিল না।
যদিও, স্ববিরোধী হলেও, Age of Reason অযৌক্তিকতার উৎপাত প্রত্যক্ষ করে। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকের ব্যাপক ডাইনী ভীতি যা ইউরোপের ক্যাথলিক আর প্রোটেষ্ট্যান্ট অনেক দেশকে ছারখার করে দিয়েছে, প্রমাণ করেছে যে মনের অশুভ শক্তিগুলোকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিপাত দমিয়ে রাখতে অপারগ। ডাইনী ভীতি ছিল একটা সমন্বিত অশুভ কল্পনার ফসল যা হাজার হাজার নারী ও পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড আর নির্যাতন নিপীড়নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। মানুষ তখন বিশ্বাস করত ডাইনীদের শয়তানের সাথে যৌন সম্পর্ক রয়েছে এবং বাতাসে ভেসে শয়তানের বন্য আনন্দোৎসবে তারা যোগ দিতে যায়। মানুষের অবচেতন মনের ভয় ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো শক্তিশালী পুরাণের অনুপস্থিতির কারণে তারা তাদের ভয়কে যুক্তির মোড়কে সিদ্ধ করতে চেয়েছে। ভীতিকর আর বিধ্বংসী কু-যুক্তি সবসময়ে মানুষের অভিজ্ঞতার অংশ হিসাবে বিরাজ করেছে এবং এখনও করছে। নতুন খ্রিস্টান আন্দোলনে খুব জোরালোভাবে এর উন্মেষ ঘটেছে যা আলোকিত যুগের ধারণাসমূহকে ধর্মীয় আঙ্গিকে ভাষান্তরের চেষ্টা করেছে। বন্ধুসভার সদস্যদের (Quaker) এই বিশেষ নামে ডাকা হয় কারণ তাদের সমাবেশের সময়ে তারা শিহরিত হয়, নেকড়ের মতো হুঙ্কার করে আর তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পিউরিটানদের অনেকে সফল পুঁজিপতি এবং খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হলেও অব্যবস্থিত আধ্যাত্মিকতা এবং স্নায়বিক রূপান্তরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন অনেকেরই তা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। ব্যাপকসংখ্যক হতাশার শিকার হন এবং কেউ কেউ এমনকি আত্মহত্যাও করে।[১০৪] নিউ ইংল্যাণ্ডের (১৭৩৪-৪০) প্রথম মহান জাগরণের সময়ও একই লক্ষণ আবার দেখা যায়। সকলেই মরমীবাদে দক্ষতা লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু মরমীবাদের উচ্চতর মার্গ সকলের জন্য না। বিশেষ প্রতিভা, মানসিকতা আর গুরু শিষ্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এর জন্য। অদক্ষ লোকের সমন্বয়ে গঠিত দলের অভিজ্ঞতা গণ উন্মত্ততা এমনকি মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে।
উনিশ শতক নাগাদ, ইউরোপের মানুষ ধর্মকে ক্ষতিকর হিসাবে ভাবতে শুরু করে। লুডউইগ ফয়েরবাখ (১৮০৪-৭২) যুক্তি উপস্থাপন করেন যে এটা মানুষকে মানবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং কার্ল মার্কস (১৮১৮-৮৩) ধর্মকে অসুস্থ সমাজের উপসর্গ হিসাবে বিবেচনা করেন। আর সত্যিই সেই সময়ের পৌরাণিক ধর্ম একটা অস্বাস্থ্যকর বিরোধ সৃষ্টির ক্ষমতা রাখতো। এটা ছিল বিজ্ঞানের যুগ এবং মানুষ বিশ্বাস করতে চাইতো যে তাদের সনাতন আচার অনুষ্ঠান নুতন যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু পুরাণগুলোকে সাহিত্যের আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে সেটা অসম্ভব একটা প্রকল্পে পরিণত হয়। চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) The Origin of Species (১৮৫৮) প্রকাশ করলে উন্মাদনায় যেন ঢাকের বোল পড়ে। ধর্মকে আঘাত করার কোনো উদ্দেশ্য বইটার ছিল না, এটা ছিল, বৈজ্ঞানিক উপপ্রমেয়র একটা সংযমী অনুসন্ধান। কিন্তু সে সময়ে মানুষ সৃষ্টিতত্ত্বের বিবর্তন তত্ত্ব এমন ভঙ্গিতে পাঠ করতো যেন সেটা প্রকৃত ঘটনা, অনেক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অনুভব করেন- এবং আজও অনুভব করেন যে বিশ্বাসের সৌধ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সৃষ্টির গল্পগুলোকে কখনও ঐতিহাসিকভাবে নির্ভুল বিবেচনা করা হয়নি; উপশম আনয়নকারী হিসাবেই এগুলোকে দেখা হতো। কিন্তু কেউ যদি সৃষ্টিতত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ভুল মনে করে পাঠ শুরু করে তাহলে সেটা হবে অপবিজ্ঞান আর অধর্মের নামান্তর।