ষোড়শ শতকে, সংস্কারকদের মাঝে এই বিচ্ছিন্নতাবোধ স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যারা ইউরোপের ধর্মকে আরো পরিশীলিত পরিমার্জিত এবং আধুনিক করার প্রয়াস নিয়েছেন। মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৩৬) যন্ত্রণাদায়ক হতাশা আর ক্রোধের আকস্মিক বহিঃপ্রকাশের শিকার হয়েছেন। উলরিখ জিংলী (১৪৮৪-১৫৩১), এবং জন ক্যালভিন (১৫০৯-৬৪) লুথারের বিবশ করা অসহায়ত্ব তারাও মানুষের অস্তিত্বের পরীক্ষার সামনে অনুভব করতেন– একটা ব্যাধি যা তাদের সমাধান খুঁজতে বাধ্য করেছে। তাদের পরিমার্জিত খ্রিস্টানধর্ম দেখায় যে বিকাশমান আধুনিক সত্তা পৌরাণিক চেতনাবোধ থেকে কতটা বিপরীত। প্রাক আধুনিক ধর্মে, সাদৃশতাকে পরিচয় হিসাবে দেখা হতো, তাই প্রতীক ছিল যে বাস্তবতা উপস্থাপন করে তার সাথে সম্পর্কিত। এখন, সংস্কারকদের মতামত অনুসারে, ইউক্যাবিষ্টের মতো কোনো কৃত্য ‘কেবল’ একটা প্রতীক- যা অপরিহার্যভাবে আলাদা। কোনো প্রাক আধুনিক কৃত্যর ন্যায়, খ্রিস্টের বলিসদৃশ মৃত্যু খ্রিস্টের নৈশভোজের পর্ব উদ্যাপনে পুনরায় বিধিবদ্ধ হয়েছে, যা পৌরাণিক হবার কারণে সময়নিরপেক্ষ এবং একে বর্তমান বাস্তবতায় পরিণত করেছে। সংস্কারকদের কাছে, এটা কেবল বিগত দিনের অনুষ্ঠানের একটা স্মারক মাত্র। বাইবেল সম্বন্ধে নতুন গুরুত্ব আরোপিত হয়, কিন্তু ছাপাখানার আবিষ্কার এবং শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি পবিত্র ভাষ্যের ব্যাপারে মানুষের ধারণা দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। নিরব নিভৃত পাঠের স্থান নিয়েছে গণ-প্রার্থনা। মানুষ এখন অনেক বিশদভাবে বাইবেলকে জানতে পারে এবং তাদের নিজস্ব ধারণা থেকে, কিন্তু এখন আর একে ধর্মীয় আচারের অংশ হিসাবে পাঠ করা হয় না, অন্যান্য আধুনিক গ্রন্থের ন্যায়, বস্তুনিষ্ঠ উপাত্তের জন্য লোকায়ত ভঙ্গিতে সহজেই এটার পাঠ করা সম্ভব।
জীবনের প্রায় সব জিনিসের ন্যায়, অনেক আধুনিক আবিষ্কারও ঝামেলা সৃষ্টিকারী। নতুন জ্যোতির্বিদ্যা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মুগ্ধ করা দৃশ্য অবারিত করেছে। নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) তার নতুন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন যা তার মাঝে ভয় আর শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানবোধের উদ্রেক ঘটিয়েছিল। কিন্তু তার প্রাপ্ত ফলাফল ছিল বিভ্রান্তকারী। পুরাণ মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে বিশ্বের নির্যাসের সাথে তারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত কিন্তু এখন এটা প্রতীয়মান হয় যে একটা ক্ষুদ্র নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণায়মান স্বতন্ত্রতাহীন গ্রহে কেবল প্রান্তিক অবস্থান তাদের রয়েছে। তারা আর নিজেদের উপলব্ধিকে বিশ্বাস করতে পারে না, কারণ আপাত স্থির পৃথিবী আসলে প্রবল গতিশীল। নিজেদের নিজস্ব ধারণা সৃষ্টির ব্যাপারে তারা ক্রমশ উৎসাহী হয়ে উঠে কিন্তু তারা আরও বেশি বেশি করে আধুনিক ‘বিশেষজ্ঞ’দের অধীন হয়ে পড়ে, যারাই কেবল বস্তুর প্রকৃতির গোপনীয়তা উদ্ঘাটন করতে সক্ষম।
বৃটেনে, ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) স্বাধীনতার একটা ঘোষণা দেন, বিজ্ঞানকে পুরাণের বন্ধন থেকে স্বাধীন করতে। Advancement of Learning-এ (১৬০৫) তিনি একটি নতুন গৌরবময় যুগের ঘোষণা করেন। মানুষের দুর্দশা বিনাশ করে বিজ্ঞান পৃথিবীকে রক্ষা করবে। কোনো কিছুই এই পরিবর্তনের গতি রোধ করতে পারবে না। সব ধর্মীয় পুরাণকে কঠোর সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করতে হবে এবং তারা যদি প্রমাণিত ঘটনার বিরোধিতা করে তবে তাদের একপাশে বাতিল বলে সরিয়ে রাখতে হবে। এই সত্যের সন্ধান কেবলমাত্র যুক্তি দিতে পারে। স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) সম্ভবত প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই প্রায়োগিক মূল্যবোধ পুরোপুরি আত্মস্থ করেছিলেন, পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের বিকাশমান বৈজ্ঞানিক ধারা কঠোরভাবে ব্যবহার করে তিনি তার পূর্ববর্তীদের প্রাপ্ত তথ্যের সংশ্লেষণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তিনি মানুষের জন্য পৃথিবী সম্বন্ধে নজীরবিহীন এবং নির্দিষ্ট তথ্য হাজির করছেন, তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছেন তা পুরোপুরি প্রকৃত ঘটনার সাথে মিলে যায় এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, মহান ‘মেকানিক’ যিনি দুর্বোধ্য বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছেন।
কিন্তু লোগোস এই সম্পূর্ণ অবগাহন উপলব্ধির অন্তজ্ঞানের রূপ আরো বেশি মূল্যায়ন করা নিউটনের জন্য অসম্ভব করে তোলে। তার কাছে পৌরাণিক তত্ত্ব আর মরমীবাদ ছিল চিন্তাধারার আদিম পদ্ধতি। তিনি অনুভব করেন খ্রিস্টান ধর্মকে ট্রিনিটির মতো মতবাদ থেকে মুক্ত করা তার কর্তব্য, যা যুক্তির নীতিসমূহ অমান্য করে। তিনি এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন যে চতুর্থ শতকের গ্রীক ধর্মবেত্তার দল এই মতবাদ কেবল একটা পুরাণ হিসাবে কল্পনা করেছিলেন, যা অনেকটা ইহুদি কাবালিস্টদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নিসসার বিশপ (৩৩৫-৩৯৫) গ্রেগরী যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, পিতাপুত্র আর পবিত্র সত্তা, মোটেই অস্তিত্বের স্বরূপ বিষয়ক বাস্তবতা না কিন্তু আমরা এই পদগুলো ব্যবহার করি; আমাদের মানবমনের সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে ‘নামহীন অব্যক্ত’ দিব্যসত্তা কিভাবে নিজেকে অভিযোজিত করে, সেটা প্রকাশ করতে।[১০০] যুক্তিপাতের দ্বারা আমরা ট্রিনিটির অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারব না। কবিতা বা সঙ্গীতে বিস্মৃতিপ্রবণ অর্থের চেয়ে বেশি কিছু এটা দ্বারা বোঝানো হয় না। কিন্তু নিউটন কেবল যৌক্তিকভাবেই ট্রিনিটির নিকটবর্তী হতে পারতেন। কোনো কিছু যদি যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা না যায়, তবে সেটা মিথ্যা। ‘ধর্মের ক্ষেত্রে মানব জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন অংশের আর উগ্রতার মাত্রা এটা,’ তিনি বিরক্ত হয়ে লেখেন, ‘সবসময়েই রহস্যের ভক্ত আর সে কারণে যেটা সবচেয়ে কম বোঝে সেটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে’[১০১] বর্তমানের কসমোলজিষ্টরা নিউটনের যৌক্তিক ঈশ্বরে আর বিশ্বাস রাখেন না কিন্তু পশ্চিমের অনেক লোকই তার যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়া আর পুরাণ সম্বন্ধে অস্বস্তিবোধে ভোগে এমনকি ধর্মীয় ব্যাপারেও। নিউটনের মতো, তারাও মনে করে যে ঈশ্বরের প্রকাশযোগ্য আর বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা থাকা উচিত। যাই হোক বহুসংখ্যক পশ্চিমা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ট্রিনিটিকে নিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে। নিউটনের মতো তারাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে ট্রিনিটি সম্বন্ধীয় পুরাণের সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এটা স্মরণ করিয়ে দিতে যে তারা যেন দৈবকে ব্যক্তিত্বের মামুলি আঙ্গিকে চিন্তা করার চেষ্টা না করে।[১০২]