বোধবুদ্ধির সীমানা অতিক্রম করাটা সব সময়ে মানুষের অভিজ্ঞতার একটা অংশ। আমরা পরমানন্দের মুহূর্ত অনুসন্ধান করি যখন আমাদের অনুভূতিগুলো তীব্রভাবে আলোড়িত হয় এবং ক্ষণিকের তরে আমরা আমাদের সত্তার ঊর্ধ্বে আরোহণ করি। সেইসব মুহূর্তে, মনে হয় যেন আমরা ভীষণভাবে বেঁচে আছি এবং আমাদের মানবতার পুরোটাই যেন জেগে উঠেছে। পরমানন্দ লাভের সবচেয়ে সনাতন উপায়ের মধ্যে একটা হলো ধর্ম কিন্তু মানুষ যখন মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় কিংবা সিনাগগে তাকে খুঁজে না পায় তারা তাকে অন্যত্র খোঁজার চেষ্টা করে : শিল্পকলা, সঙ্গীত, কবিতা, নৃত্য, মাদক, যৌনতা বা অন্য কিছু। সঙ্গীত বা কবিতার মতো, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এবং বিলুপ্তির সম্ভাবনায় আমাদের মাঝে জন্ম নেয়া হতাশা উড়িয়ে দিয়ে, পুরাণতত্ত্ব তুরীয় আনন্দ আমাদের মাঝে জাগ্রত করবে। কোনো পুরাণ যদি তা করা বন্ধ করে তবে বুঝতে হবে যে এর প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে এবং পুরাণটির মৃত্যু ঘটেছে।
পুরাণকে সেজন্য চিন্তার অনুন্নত ধরন, যাকে মানুষের বিচারবুদ্ধির উন্মেষের সাথে সাথে দ্বিতীয় কাতারে সরিয়ে দেয়া যাবে এমনটা ভাবা আমাদের ভুল হবে। পুরাণতত্ত্ব ইতিহাস রচনার কোনো প্রাথমিক প্রয়াস না এবং সে এটাও দাবী করে না যে এর সমস্ত গল্পই বস্তুনিষ্ঠ ঘটনা। উপন্যাস বা নাটকের মতো পুরাণও মনগড়া; এটা একটা খেলা যা ‘যদি এমন হতো?’ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আমাদের শোকাবহ অসম্পূর্ণ পৃথিবীকে মহিমান্বিত করে তোলে এবং নতুন সম্ভাবনার আশা জোগায় — এই একই প্রশ্ন দর্শন এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সূচনা করেছে। নিয়ানডারথাল মানুষেরা যারা তাদের মৃত সঙ্গীদের নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছে তারাও সম্ভবত এই একই ধরনের মন-গড়া আধ্যাত্মিক খেলায় মেতেছিল, যা সব পুরাণ নির্মাতাদের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় : “যদি এমন হয় যে এই পৃথিবীই সবকিছু না? আমাদের জীবনকে এটা কিভাবে প্রভাবিত করে- সামাজিক বাস্তবিক বা মানসিকভাবে? আমরা অন্য কিছুতে পরিণত হই? আরো সম্পূর্ণ? এবং যদি আমরা খুঁজে পাই যে আমরা আসলেই পরিবর্তিত হয়েছি তাহলে কি এটাই বোঝা যায় না যে আমাদের পৌরাণিক বিশ্বাস কোনো না কোনো ভাবে সত্যি, যে আমাদের মানবতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সে আমাদের বলতে চায়, যা যৌক্তিকভাবে আমরা হয়তোবা প্রমাণ করতে অপারগ?”
আনন্দ করার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারার কারণেই মানুষ অনন্য।[২] বন্দিত্বের কৃত্রিম পরিবেশে বসবাস করা ছাড়া, অন্যান্য প্রাণী যখন প্রকৃতির মাঝে জীবনের কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হয় তখন তারা তাদের প্রাথমিক আনন্দের বোধটাই হারিয়ে ফেলে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অবশ্য নানা সম্ভাবনা বাজিয়ে দেখা অব্যাহত রাখে এবং শিশুদের মতো আমরা আমাদের জন্য কল্পনার একটা জগৎ তৈরি করে নেই। চিত্রকলায়, যুক্তি আর কারণের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা নতুন আঙ্গিকের ধারণার জন্ম দেই যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে এবং আমরা বিশ্বাস করি যা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং চরমভাবে ‘সত্যি’ কিছু একটার কথা বলে। পুরাণ তত্ত্বেও, তেমনি, কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে, আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট করে, আমাদের জীবনে এর প্রভাব বিবেচনা করে আমরা কোনো উপপ্রমেয়কে গুরুত্ব দিয়ে থাকি এবং আবিষ্কার করি যে আমাদের পৃথিবীর বিভ্রান্তিকর সব প্রশ্নের নতুন পরিজ্ঞান আমরা লাভ করেছি।
বস্তুগত তথ্য সরবরাহ করার কারণে না, কার্যকর এ কারণেই, পুরাণ সত্যি। জীবনের গভীর মানের ব্যাপারে সে যদি আমাদের নতুন পরিজ্ঞান দিতে না পারে তবে বলতে হবে পুরাণ ব্যর্থ হয়েছে। যদি এটা কাজ করে, মানে, যদি এটা আমাদের মনমানসিকতা পরিবর্তনে বাধ্য করে, আমাদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে এবং আমাদের আরো পূর্ণাঙ্গভাবে বাঁচতে বাধ্য করে তবে এটা একটা বৈধ পুরাণ। পুরাণতত্ত্ব আমাদের তখনই পরিবর্তিত করবে যদি আমরা এর অনুশাসন অনুসরণ করি। পুরাণ কার্যত একটা নির্দেশিকা; কি করে আরো ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায় সে কথাই সে আমাদের বলে। আমরা যদি এই অনুশাসন আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করি, একে আমাদের নিজেদের জীবনে বাস্তবতা দিতে ব্যর্থ হই তবে বোর্ড গেমের নিয়মের মতো যা অনেক সময় বিভ্রান্তিকর এবং বিরক্তিকর, সেরকম দুর্বোধ্য এবং অব্যবহৃত থেকে যাবে যতক্ষণ আমরা খেলা শুরু না করি।
পুরাণ থেকে আমাদের আধুনিকতার বিচ্যুতি অভূতপূর্ব। প্রাক-আধুনিক যুগের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল পুরাণ। মানুষকে জীবনের মানে বুঝতেই এটা কেবল তাদের সাহায্য করেনি, সেই সাথে মানব মনের এমন সব ক্ষেত্রকে উদ্ভাসিত করেছে যা হয়তো অন্যথায় অগম্যই রয়ে যেত। মনোবিদ্যার এটা একটা প্রাথমিক রূপ। দেবতা এবং বীরদের পাতালে অবতরণের গল্প, গোলকধাঁধাঁর মাঝে পথ খুঁজতে খুঁজতে অসুরের সাথে যুদ্ধ, আত্মার রহস্যময় আচরণের উপরে আলো নিক্ষেপ করে মানুষকে দেখিয়েছে কিভাবে নিজেদের মানসিক টানাপোড়েনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। ফ্রয়েড এবং জুঙ আত্মার নবীন অভিযানের রেখচিত্র প্রণয়ন আরম্ভ করার সময়ে, তারা তাদের পরিজ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্য সহজাতভাবেই ধ্রুপদী পুরাণতত্ত্বের দ্বারস্থ হন এবং পুরাতন পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা দেন।