কিন্তু একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টানরা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর অন্ধকার যুগে প্লাটো আর এরিস্টটলের হারিয়ে যাওয়া কাজ পুনরাবিষ্কার করে। ঠিক সেই সময়ে যখন ইহুদি আর মুসলমানেরা তাদের পুরাণকে যুক্তিপাতে ফেলার প্রয়াস থেকে সরে আসতে শুরু করেছে, পশ্চিমা খ্রিস্টানরা এই কাজে লাফিয়ে পড়ে এমন একটা উৎসাহ নিয়ে যা তারা কখনও সম্পূর্ণ হারাবে না। পুরাণের অর্থ তারা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। অবাক হবার তাই কিছু থাকে না যখন মানব ইতিহাসের পরবর্তী মহান রূপান্তর শুরু হয়, যা পৌরাণিক আঙ্গিকে চিন্তা করাটা মানুষের জন্য দুরূহ করে তুলবে।
৭. পাশ্চাত্যের মহান রূপান্তর
(পনের শতক থেকে বিংশ শতক)
ষোড়শ শতকে ভুল শোধরানো না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা চালিয়ে যাবার পদ্ধতি ব্যবহার করে, ইউরোপের মানুষ এবং পরে, পরবর্তীকালে যা আমেরিকা বলে অভিহিত হবে, সেখানকার মানুষ এমন একটা সভ্যতার নির্মাণ শুরু করে যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই এবং ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী নাগাদ মানচিত্রের অন্যান্য অংশে এই কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়বে। এটা মানুষের অভিজ্ঞতার শেষ মহান বিবর্তন। কৃষিকাজের উদ্ভব বা নগর পত্তনের মতো, এটারও একটা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, যার ফলাফল আমরা কেবলমাত্র উপভোগ করতে শুরু করেছি। জীবন আর কখনও আগের মতো হবে না, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবত– এবং সম্ভাব্য দুর্যোগআকীর্ণ– এই নতুন পরীক্ষার ফলাফল পুরাণের মৃত্যু।
লোগোসের মানসপুত্র পাশ্চাত্য সভ্যতা। একটা ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরে এটা প্রতিষ্ঠিত। কৃষিপণ্যের উদ্বৃত্তের উপরে নির্ভর করার বদলে, যা সব প্ৰাক- আধুনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য, নতুন পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পদের প্রযুক্তিগত পুনরাবৃত্তি আর পুঁজির পূর্ণ বিনিয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত। সনাতন সংস্কৃতির, যার কৃষিভিত্তি অনিবার্য কারণেই ছিল অনিশ্চিত। অনেক বিধিনিষেধ থেকে আধুনিক সমাজকে এটা মুক্তি দিয়েছে। আজকের আগে পর্যন্ত কোনো আবিষ্কার বা ধারণা যা বাস্তবায়ন করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন সমূহ সম্ভাবনা ছিল তা স্থগিত রাখার কারণ আমাদের আগে কোনো সমাজই আজ যা আমরা সম্ভব বলে প্রথমেই ধরে নেই, সেই বিরামহীনভাবে কাঠামোর পুনরাবৃত্তির হ্যাপা সামলাতে পারতো না। জমির উর্বরতা আর ফসলের ফলনের জন্য নানা প্রভাবকের উপর নির্ভর করতে হতো বলে কৃষিজীবী সমাজ ছিল ঘাতোপযোগী। সাম্রাজ্য কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে নিজের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতো এবং অনিবার্যভাবে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি নিঃশেষ করে ফেলতো। কিন্তু পশ্চিমে এমন একটা অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে আপাতদৃষ্টিতে যা অনন্তকালব্যাপী পুনর্নবায়নের সম্ভাবনাযুক্ত। অতীতের দিকে তাকিয়ে যা অর্জিত হয়েছে তা রক্ষা করা, যা ছিল প্রাক-আধুনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য, এই মনোভাব পরিত্যাগ করে পশ্চিমের মানুষ সামনের দিকে তাকাতে শুরু করেছে। আধুনিকায়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়া : যা সম্পন্ন করতে ইউরোপের প্রায় তিন শতাব্দী প্রয়োজন হয়েছে, ব্যাপক পরিবর্তনের একটা ধারাবাহিক সমাবেশ : শিল্পায়ন, কৃষির রূপান্তর, নতুন শর্ত পূরণ সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের স্বীকৃতি, এবং একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ‘বিকাশ’ যা মিথ্যা, অদরকারী আর বাতিল, অচল বলে পুরাণের মানহানি ঘটিয়েছে।
বৈজ্ঞানিক, প্রয়োগকারী সত্তার উপর নির্ভর করেই এসেছে পশ্চিমাদের অর্জন। দক্ষতা আজ নতুন মন্ত্রশব্দ। সবকিছুকে কাজ করতে হবে। একটা নতুন আবিষ্কার বা ধারণার যুক্তিপাতের সামর্থ্য থাকতে হবে এবং দেখতে হবে সেটা বহির্জগতের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। পুরাণের মতো নয়, লোগোসকে অবশ্যই ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে; এটা মূলত প্রায়োগিক, আমরা যখন কিছু করতে চাই তখন চিন্তার এই পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করি; আমাদের পরিবেশের উপর আরো অধিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বা নতুন কিছু আবিষ্কারের তাগিদে এটা সবসময় সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পশ্চিমা সমাজের নতুন নায়ক তাই এখন থেকে বিজ্ঞানী বা উদ্ভাবক যিনি তার সমাজের জন্য অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রে অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তাকে প্রায়ই পুরাতন পবিত্র অনুভূতি ছুঁড়ে ফেলতে হয়– যুগান্তকারী পর্বের ঋষিরা যেমনটি করেছিলেন। পশ্চিমা আধুনিকতার এই নায়করা কিন্তু লোগোসের প্রযুক্তিগত বা বৈজ্ঞানিক প্রতিভা মিথোস দ্বারা অনুপ্রাণিত আধ্যাত্মিক প্রতিভা নন। তার মানে দাঁড়ায় যে ভাবনার অন্তজ্ঞানলব্ধ পৌরাণিক পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতার প্রায়োগিক যুক্তিবাদী সত্তার কাছে অবহেলিত হবে। কারণ পাশ্চাত্যের অধিকাংশ লোকই পুরাণ ব্যবহার করে না, এটা কি সে জ্ঞানও অনেক খুইয়ে বসেছে।
পশ্চিমে আজ নতুন আশাবাদী মানুষ অনুভব করে যে প্রকৃতির উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ বেশি। পবিত্র, অপরিবর্তনীয় আইন বলে আর কিছু নেই। বেঁচে থাক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আজ তারা প্রকৃতিকে পরিচালিত করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। আধুনিক ঔষুধের আবিষ্কার স্বাস্থ্যবিধি, শ্রমিকের উপরে নির্ভরতা কমিয়ে আনা প্রযুক্তি আর উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা পশ্চিমা মানুষের জীবনযাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কিন্তু লোগোস মানুষকে কখনও গুরুত্বের সেই বোধটা দিতে পারবে না যেটার প্রয়োজন তাদের আছে। জীবনকে মানে দিয়েছে আর ছাঁচে ফেলেছে পুরাণ। কিন্তু আধুনিকতার অগ্রসর হবার সাথে এবং লোগোসের চমকপ্রদ অর্জনের ফলে পৌরাণিক তত্ত্বের সুনাম ক্রমেই খর্ব হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ, আমরা, অসাড় হতাশার আরো নজির, ক্রমবর্ধমান মানসিক জড়তা এবং একটা অক্ষমতাবোধ আর তদজনিত ক্ষোভ, পুরাতন পৌরাণিক চিন্তাধারা ভেঙে পড়লে এবং তার স্থানে নতুন কিছুর আবির্ভাব না হলে, লক্ষ্য করি। উন্নতশীল দেশগুলোতে একই ধরনের সামাজিক মূল্যবোধহীনতাজনিত পরিস্থিতি লক্ষ্য করি যারা আধুনিকায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে এখনও রয়েছে।