খ্রিস্টান আর মুসলমান ইতিহাসেও অনুরূপ উদাহরণ রয়েছে। পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্যের যখন পতন হয়, সেন্ট অগাষ্টিন (৩৫৪-৪৩০) উত্তর আফ্রিকার হিপ্পোর বিশপ, আদম আর ঈভের পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা করেন এবং আদিপাপের পুরাণের সৃষ্টি করেন। আদমের অবাধ্যতার কারণে, ঈশ্বর সমগ্র মানব জাতিকে অনন্ত নরকদণ্ড দেন (আরেকটা ধারণা যার কোনো বাইবেলীয় ভিত্তি নেই)। যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে আদমের উত্তরপুরুষদের মাঝে এই পাপ উত্তরাধিকারসূত্রে আরোপিত হতে থাকে, যা ‘কামপ্রবৃত্তি’ দ্বারা দূষিত, ঈশ্বরের চেঁয়ে মামুলি প্রাণীর মাঝে আনন্দ আহ্বানের অযৌক্তিক কামনা, প্রথম পাপের স্থায়ী ফল। কামপ্রবৃত্তি যৌনক্রিয়ায় সবচেয়ে পরিপূর্ণভাবে প্রতিভাত হয়, যখন ঈশ্বরের কথা মনে থাকে না এবং মানুষ নির্লজ্জভাবে একে অন্যের সাথে আনন্দে মাতে। যুক্তির এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুভূতির বিশৃঙ্খলা দ্বারা অধঃপতিত হয়েছে রোমের চাকচিক্যের সাথে যার বিশ্রী রকমের মিল, যা ছিল পশ্চিমের যৌক্তিকতা আইন আর শৃঙ্খলার উৎস, বর্বর সম্প্রদায়ের হাতে নাজেহাল হয়েছে। আদি পাপের পুরাণকে পশ্চিমা খ্রিস্টানরা তাদের বিশ্বাসের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচনা করে কিন্তু বাইজেনটাইনের গ্রীক অর্থোডক্সেরা, যেখানে রোমের পতন হয়নি, এই মতবাদকে কখন পুরোপরি স্বীকৃতি দেয়নি, তারা বিশ্বাস করে না যে যীশু আদি পাপের শাস্তি থেকে আমাদের বাঁচাতে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে আদম যদি পাপ নাও করতো ঈশ্বর হয়তো মানুষে পরিণত হতেন।
ইসলামে মরমীবাদীরা বিচ্ছিন্নতার এবং ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাবার পুরাণ বিকশিত করেছে। তারা বলে যে জেরুজালেমের মসজিদ থেকে হযরত মহম্মদ (স:) আল্লাহর আরশে এক অতীন্দ্রিয় আরোহণ করেছিলেন। মুসলমান আধ্যাত্মিকতার আদিরূপে পরিণত হয়েছে এই পুরাণ এবং সুফীরা হযরতের নিখুঁত ইসলামী আচরণ বা ঈশ্বরের কাছে ‘সমর্পণ’কে প্রতীকীরূপ দিতে এই অতীন্দ্রিয় ভ্রমণের সাহায্য নেয়। শিয়া মুসলমানেরা মহানবীর পুরুষ বংশধরদের ব্যাপারে একটা পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়েছে, যারা তাদের ইমাম (নেতা)। প্রত্যেক ইমাম দিব্য ইলম এর প্রতিমূর্তি। যখন এই ধারা শেষ হয় তারা বলে যে শেষ ইমাম ‘Occultation’-এর পর্যায়ে গিয়েছেন এবং একদিন তিনি ফিরে এসে শান্তি আর ন্যায়বিচারের যুগের সূচনা করবেন। এইখানে, শিয়া মতবাদ প্রাথমিকভাবে মরমী আন্দোলন এবং ধ্যানের বিশেষ পদ্ধতি এবং আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ছাড়া এই পুরাণের কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। শিয়ারা নিশ্চিতভাবেই চায় না আক্ষরিক অর্থে তাদের পুরাণের ব্যাখ্যা করতে। ইমামতির এই পুরাণ, মুসলমান গোড়ামিকে যা অবজ্ঞা করে, ঐশ্বরিক উপস্থিতির বোধ প্রকাশে মরমীদের একটা প্রতীকী প্রয়াস, বিপজ্জনক পৃথিবীতে অন্তর্নিহিত এবং গ্রহণযোগ্য। লুক্কায়িত ইমাম একটা মিথে পরিণত হয়েছেন, সাধারণ ইতিহাস থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে তাকে সময় আর স্থানের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে এবং আপাতবিরোধী মনে হলেও সত্যি যে এভাবেই তিনি শিয়াদের জীবনে আরো প্রবলভাবে বর্তমান আছেন, আব্বাসীয় খলিফার আদেশে গৃহবন্দি থাকাকালীন সময়ের চাইতে। গল্পটা বিস্মৃতিপ্রবণ হিসাবে ঐশ্বরিকতা সম্বন্ধে আমাদের বোধকে প্রকাশ করে এবং এই পৃথিবীতে লোভনীয়তার রেশ জাগিয়ে অনুপস্থিত কিন্তু এর শেষ নেই।
মিথোস আর লোগোসের মাঝে গ্রীকরা ইহুদিদের কিছু অংশ, খ্রিস্টান এবং মুসলমানেরা বিভক্তি অনুভব করার কারণে তাদের সংস্কৃতিতে পৌরাণিকতার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সত্ত্বেও এ বিষয়ে অস্বস্তিবোধ করে। অষ্টম আর নবম শতকে প্লাটো আর এরিস্টোটলের লেখা যখন আরবীতে অনূদিত হয় কিছু মুসলমান চেষ্টা করেছিল কোরআনের ধর্মের বদলে একে লোগোসের ধর্মে পরিণত করতে। তারা ‘আল্লাহ’র অস্তিত্বের ‘প্রমাণ’ বিকশিত করে, এরিস্টোটলের প্রথম কারণ প্রতিপাদনের উপর ভিত্তি করে। তাদের ফালয়াসুফ (faylasuf) বলা হতো, তারা আদিম পৌরাণিক বলে বিবেচিত সবকিছু থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। তাদের কাজটা ছিল কঠিন। কারণ দার্শনিকদের ঈশ্বরের আটপৌরে ঘটনা সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই ইতিহাসে নিজেকে প্রকাশ করেননি, পৃথিবী সৃষ্টি করেননি এবং মানুষের অস্তিত্বের কথাই জানেন না। এসব ছাড়া ফালয়াসুফরা একটা চমকপ্রদ কাজ করেছিল, মুসলিম সাম্রাজ্যে বসবাসকারী ইহুদিদের সাথে মিলে বাইবেলের ধর্মকে যুক্তিপাতে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। এসব সত্ত্বেও ফালয়াসুফরা সংখ্যালঘু রয়ে যায়, ক্ষুদ্র অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠীতে নিজেদের আবদ্ধ রাখে। বাইবেলের আর কোরআনের ঈশ্বরের চেয়ে প্রথম কারণ অনেক বেশি যৌক্তিক কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের কাছে এমন দেবতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া মুশকিল যিনি তাদের প্রতি এত উদাসীন।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, গ্রীক অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা এই যৌক্তিক প্রকল্প অপছন্দ করতো। তারা নিজেদের আপন হেলেনীয় প্রথা সম্বন্ধে জানতো এবং আরো ভালো করে জানতো যে, প্লাটো যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, তেমন লোগোস আর মিথোস ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবে না। তাদের দৃষ্টিতে ধর্মতত্ত্বের অধ্যয়ন যৌক্তিক অনুশীলন হতে পারে না। কাটা চামচ দিয়ে স্যুপ খাবার মতো অর্থহীন ব্যাপার হবে যুক্তি দিয়ে দিব্যকে নিয়ে আলোচনা করা। বিধিবদ্ধ প্রথা আর প্রার্থনার মাধ্যমে অগ্রসর হলেই কেবল ধর্মতত্ত্বের নির্যাস পাওয়া সম্ভব। মুসলমান এবং ইহুদিরা একটা সময়ে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছে। একাদশ শতক নাগাদ, মুসলমানেরা সিদ্ধান্ত নেয় দর্শনকে অবশ্যই আধ্যাত্মিকতার কৃত্যানুষ্ঠান এবং প্রার্থনার সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে এবং সুফীদের পৌরাণিক মরমী ধর্ম উনিশ শতক নাগাদ ইসলামে নিয়মাত্মক রূপ লাভ করে। একইভাবে ইহুদিরা আবিষ্কার করে যে, স্পেন থেকে বিতাড়নের মতো বিয়োগাত্মক ঘটনা দ্বারা যখন তারা পীড়িত হয় তাদের দার্শনিকদের যৌক্তিক ধর্ম তাদের কেনো সাহায্যে আসে না এবং তাদের কাবালাহ্র পুরাণের দ্বারস্থ হতে হয় যা মনের স্নায়বিক স্তরের মধ্যে চালিত হয়ে তাদের কষ্ট আর আকুতির অন্তর্নিহিত উৎস স্পর্শ করে। পুরাণ আর যুক্তির পুরাতন পরিপূরক দৃষ্টিভঙ্গির শরণ নেয় তারা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান গণিত আর চিকিৎসাবিদ্যার মতো ক্ষেত্রে লোগোস অপরিহার্য- মুসলমানদের যাতে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু তারা যখন পরমার্থ এবং তাদের জীবনের মানে খুঁজতে চায়, যখন তারা তাদের হতাশা হ্রাস করতে চেষ্টা করে বা নিজের ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত অঞ্চলের অনুসন্ধান করতে চায়, তারা পুরাণের রাজত্বে প্রবেশ করে।