অন্য পুরাণের প্রতি ইহুদি মতবাদের মনোভাব অনেক স্ববিরোধিতায় ক্লিষ্ট। অন্য জাতির পুরাণের প্রতি একে শত্রুভাবাপন্ন বলে মনে হয়, কিন্তু কখনও কখনও ইহুদি ভাবধারা প্রকাশ করতে তারা এসব বিদেশী গল্পের সাহায্য অকাতরে নিয়ে থাকে। আর তাছাড়া ইহুদি মতবাদ আরো পুরাণের সৃষ্টিকে প্রবুদ্ধ করা অব্যাহত রেখেছে। তার মধ্যে একটা হলো খ্রিস্টানধর্ম। যীশু আর তার প্রথম দিকের শিষ্যরা সবাই ছিল ইহুদি আর ইহুদি আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী, যেমন সেন্ট. পল, যিনি যীশুকে বলা যায় প্রায় পৌরাণিক চরিত্রে রপান্তরিত করেছেন। যদিও মর্যাদাহানিকর কোনো ইচ্ছা থেকে না। যীশু ছিলেন একজন সত্যিকারের ঐতিহাসিক চরিত্র, ৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রোমানরা তাকে হত্যা করেছিল এবং তার প্রথম শিষ্যরা নিশ্চিতভাবে ভেবেছিল যে তিনি– কোনো একটা অর্থে মৃত্যু থেকে জাগ্রত হয়েছেন। একটা ঐতিহাসিক ঘটনাকে যতই পৌরাণিকায়ন করা হোক এটা কখনও ধর্মীয় উৎসাহের উৎস হতে পারে না। পুরাণ হলো একটা ঘটনা যাকে স্মরণ করা হবে যা– কোনো এক অর্থে- একদা সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু যা একই সাথে সব সময়ে ঘটছে। একটা ঘটনাকে মুক্ত হতে হবে, যেভাবে ঘটেছিল, একটা নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডি থেকে এবং সমসাময়িক উপাসকদের জীবনে আনয়ন করতে হবে নতুবা এটা একটা অনন্য, পুনরাবৃত্তিহীন ঘটনা হিসাবে রয়ে যাবে বা একটা ঐতিহাসিক খেয়াল যা সত্যিকারের অর্থে কারো জীবন স্পর্শ করতে অপারগ। আমরা জানি না মিশর থেকে পালাবার সময়ে এবং সি অব রীড অতিক্রমকালে ইসরাইলের মানুষের ভাগ্যে কি ঘটেছিল কারণ গল্পটা একটা পুরাণের মতো করে লেখা হয়েছে। পাসওভারের আচার আনুষ্ঠানিকতা বহু শতাব্দী ধরে এই কাহিনীকে ইহুদিদের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রে পরিণত করেছে যা তাদের বলেছে যে তারা নিজেদের প্রত্যেককে মিশর থেকে পালিয়ে আসা বংশধর বলে মনে করবে। একটা পুরাণকে রূপান্তরকারী আচার অনুষ্ঠান ব্যতীত সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায় না, যা বংশ পরম্পরায় উপাসকদের হৃদয়ে এবং জীবনে একে বাঁচিয়ে রেখেছে। পুরাণ যজ্ঞ দাবী করে : যাত্রা পুস্তকের পুরাণ দাবী করে যে ইহুদিরা স্বাধীনতাকে পবিত্র বলে সম্মান করবে এবং অপরের নিপীড়ন আর তাদেরকে দাসে পরিণত করার প্রয়াসে বাধা দেবে। আচার অনুষ্ঠান এবং নৈতিক স্বীকৃতি দ্বারা, গল্পটা অতীতের কোনো ঘটনা হিসাবে বিদ্যমান না থেকে একটা জীবন্ত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।
যীশুর সাথে সেন্ট পলও একই কাজ করেছেন। যীশুর শিক্ষা সম্বন্ধে তার খুব একটা উৎসাহ ছিল না, যা তিনি সামান্যই উদ্ধৃত করতেন, তার পার্থিব জীবন সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘আমরা যদি কখনও রক্ত মাংসের যীশুকে জেনেও থাকি,’ কোরিন্থিয়ানের ধর্মান্তরিতদের উদ্দেশে তিনি লেখেন, ‘এখন তাকে আর আমরা সেভাবে জানি না’।[৯৪] গুরুত্বপূর্ণ হলো তার মৃত্যু আর পুনরুত্থান সংক্রান্ত ‘রহস্য’ (গ্রীক মিথোস আর এই শব্দটা একই উৎস থেকে আগত)। পল যীশুকে রূপান্তরিত করে, অনন্ত পৌরাণিক বীরে পরিণত করেন, মারা গিয়ে নতুন জীবনে যার উত্থান হয়েছে। তাকে ক্রুশবিদ্ধকরণের পরে, যীশু ঈশ্বর কর্তৃক একটা অনন্য উচ্চতর মাত্রা লাভ করেন, অস্তিত্বের ঊর্ধ্বতর মার্গে ‘আরোহণ’ তিনি অর্জন করেন।[৯৫] কিন্তু সবাই যারা আঙ্গুদীক্ষার আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয় (পানিতে অবগাহন করিয়ে সনাতন রূপান্তরিতকরণ) যীশুর মৃত্যুতে প্রবেশ করে তার নতুন জীবন ভাগ করে নেয়।[৯৬] যীশু এখন আর কেবলই একটা ঐতিহাসিক চরিত্র না কিন্তু খ্রিস্টানদের জীবনে একটা আধ্যাত্মিক বাস্তবতা, আচার অনুষ্ঠান আর নৈতিক অনুশাসন দ্বারা জীবনযাপন করে তারা তার মতো নিঃস্বার্থ জীবন পেতে চায়।[৯৭] ‘রক্তমাংসের’ যীশুকে খ্রিস্টানরা আর চেনে না কিন্তু আগমন বার্তা আর অন্যান্য শ্লোক পাঠ করে অন্য মানুষের মাঝে তারা তাকে খুঁজে পায়।[৯৮] তারা জানে এই পুরাণটা সত্যি, ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকার কারণেই কেবল না, তাদের নিজেদেরও রূপান্তরের অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেও। এভাবে যীশুর মৃত্যু আর ‘জেগে ওঠা’ একটা পুরাণ, এটা একদা যীশুর জীবনে ঘটেছিল এবং এখন সব সময়ে ঘটে চলেছে।
খ্রিস্টানধর্ম অ্যাক্সিয়াল যুগের একেশ্বরবাদের পরবর্তী সময়ের পুনরুক্তি; আরেকটা হলো ইসলাম ধর্ম। মুসলমানেরা মহানবী (স:) (৫৭০-৬৫২)কে যীশু এবং বাইবেলীয় দৈবজ্ঞদের উত্তরসূরী বলে মনে করে। পবিত্র কুরআন শরীফ, আরবদের মাঝে নাযিল হওয়া পবিত্র গ্রন্থ, তার সাথে পুরাণের কোনো সমস্যা নেই। এর প্রতিটা শ্লোককে আয়াত বলা হয়, নীতিগর্ভ রূপকের আকারে রচিত। দৈবজ্ঞদের সম্বন্ধে সব কাহিনী– নূহ (আঃ), ইব্রাহিম (আঃ) বা ঈসা (আঃ)- সব আয়াত, ‘নীতিগত রূপকের উপমা,’ কারণ ঐশ্বরিক সম্বন্ধে আমরা কেবল প্রতীক আর স্মারকের সাহায্যে কথা বলতে পারি। আরবী শব্দ কুরআনের মানে ‘আবৃত্তি’। অন্যান্য লোকায়ত গ্রন্থের ন্যায়, তথ্যের জন্য নিভৃতে এই গ্রন্থ অধ্যয়ন করা ঠিক না, মসজিদের পবিত্র পরিবেশে এর পাঠ আবশ্যক এবং যতক্ষণ না একজন মুসলমান এর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জীবনযাপন না করবে কুরআনের সম্পূর্ণ তাৎপর্য তার কাছে প্রতিভাত হবে না।