প্লাটো ট্রাজেডি অপছন্দ করতেন এর আবেগপ্রবণতার কারণে, তিনি বিশ্বাস করতেন আত্মার অযৌক্তিক অংশকে এটা পরিপূর্ণ করে এবং লোগোসের মাধ্যমেই মানুষ কেবল নিজের সম্পূর্ণ সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটাতে পারবে।[৮৮] পুরাণকে তিনি পুরাতন স্ত্রীর গল্পের সাথে তুলনা করেছেন। কেবল যৌক্তিক আলোচনাই সত্যিকারের বোঝাপড়ার জন্ম দিতে পারে।[৮৯] প্লাটোর চিরন্তন ধারণার সূত্রকে প্রাচীন দিব্য আদিরূপ পুরাণের দার্শনিক সংস্করণ ধরা যেতে পারে, পার্থিব বস্তু যার ন্যূনতম রূপ। কিন্তু প্লাটো মনে করতেন পুরাণ বা আচার অনুষ্ঠানের অন্তজ্ঞান দ্বারা প্রেম, সৌন্দর্য্য, ন্যায়বিচার বা ভালোকে অনুধাবন বা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব না সেটা কেবল মনের যুক্তিপাতের শক্তি দ্বারা সম্ভব। এরিস্টোটলও প্লাটোর মতবাদ মানতেন। পুরাতন পুরাণ তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো : ‘কারণ তারা দেবতাদের বা তাদের থেকে সঞ্জাতকে প্রথম নীতি বলে মেনে নিয়েছিল এবং বলেছিল যে অমৃত আর অমৃতের স্বাদ যে লাভ করেনি সে মরণশীল… কিন্তু এসব কারণের সত্যিকারের প্রয়োগ বিবেচনা করলে, এসব উদ্ধৃতি আমাদের বোধগম্যতার বাইরে’। দার্শনিক ভাষ্য মনে করে এরিস্টোটল পুরাণ পাঠ করতেন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব পুরাণ গাঁজাখুরির নামান্তর এবং সত্যের একনিষ্ঠ সন্ধানীর উচিত ‘প্রয়োগ দ্বারা যুক্তি অবতারণা করে সেদিকে মনোযোগ দেয়া’।[৯০] আপাতদৃষ্টিতে এখন মনে হয় লোগোস আর মিথোসের ভিতরে দর্শন পাঠ একটা টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে, যা এযাবৎ কাল পর্যন্ত পরিপূরক ছিল।
কিন্তু এটাও পুরো সম্পূর্ণ না। পুরাণের উপর যতই বিরক্ত থাকুক, ধারণার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্লাটো একে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছিলেন যা দার্শনিক ভাষার পরিধির বাইরে অবস্থিত। লোগোসের ভাষা ব্যবহার করে আমরা শুভ সম্বন্ধে কিছু বলতে অপারগ কারণ এটা কোনো সত্তা না, কিন্তু একইসাথে সত্তা আর জ্ঞানের উৎস। আরো ব্যাপার আছে যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি বা দেবতাদের জন্ম যা আপাতদৃষ্টিতে অন্ধ বিশ্বাসের বিষয় এবং অযৌক্তিকতা দ্বারা এতটাই জারিত যে সামঞ্জস্যপূর্ণ তর্কে তাদের প্রকাশ করা অসম্ভব ব্যাপার। তাই বিষয়বস্তু দার্শনিক গণ্ডির বাইরে চলে গেলে, গ্রহণযোগ্য রূপকথা দ্বারা আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।[৯১] প্রাচ্যের পুরাতন পুনরুত্থানের ও পুরাণের দ্বারস্থ হন প্লাটো।[৯২] এরিস্টোটল স্বীকার করেন যে, দেবতা সম্পর্কিত কিছু কিছু পুরাণ পরিষ্কার বানোয়াট হলেও, এই প্রথার ভিত্তি ‘যে প্রথম সব উপাদানই ছিল দেবতা’- এটা ‘সত্যিই ঐশ্বরিক’।[৯৩]
পশ্চিমা চিন্তায় তাই একটা অসঙ্গতি রয়েছে। গ্রীক লোগোস পুরাণ বিরোধী বলে মনে হয়, কিন্তু দার্শনিকেরা পুরাণ ব্যবহার অব্যাহত রাখেন, হয় যৌক্তিক চিন্তার প্রাচীন প্রতিনিধি হিসাবে বা ধর্মীয় আলোচনায় তাকে অচ্ছেদ্য আখ্যা দিয়ে। গ্রীক যুক্তিপাতের বিপুল অর্জন সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল সময়ে গ্রীক ধর্মের উপর এর কোনো প্রভাব ছিল না। গ্রীকরা দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা অব্যাহত রাখে, এ্যলুসিনিয়ান রহস্যময়তায় অংশ নেয়, তাদের উৎসব ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বজায় রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত এই পৌত্তলিক ধর্ম জোরপূর্বক সম্রাট জাস্টিনিয়ান দমন করে খ্রিস্টান মতবাদের মিথোস আরোপ না করেন।
৬. যুগান্তকারী পর্বের পরবর্তী সময়
(খ্রি: পূ: ২০০০-১৫০০)
আমাদের ইতিহাস পর্যবেক্ষণে এখন পর্যন্ত প্রধান প্রধান সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক আর আধ্যাত্মিক বিপ্লবের প্রতি আমরা আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছি যা মানুষকে তাদের পৌরাণিক তত্ত্ব সংশোধনে বাধ্য করেছে। যুগান্তকারী অ্যাক্সিয়াল যুগের পরের হাজার বছরে তুলনা করার মতো কোনো পরিবর্তন হয়নি। আধ্যাত্মিক আর ধর্মীয় ব্যাপারে আমরা এখনও যুগান্তকারী সময়ের ঋষি আর দার্শনিকদের অন্তর্জানের উপর নির্ভর করি এবং ষোড়শ শতকের পূর্ব পর্যন্ত পুরাণের পরিস্থিতি মূলত অপরিবর্তিত থাকে। এই ইতিহাসের বাকী অংশে আমরা পশ্চিমে মনোযোগ নিবদ্ধ করবো, নবমার্গের পরবর্তী পর্যায় এখান থেকে শুরু হয়েছে বলেই কেবল না, কিন্তু একই সাথে পশ্চিমের মানুষ এই সময় পুরাণ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তেও শুরু করেছে। পশ্চিমের ধর্মও আমরা খুটিয়ে দেখবো, কারণ একেশ্বরবাদের তিনটি মতবাদের দাবী, কিছুটা হলেও, ইতিহাসের চেয়ে পুরাণের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। অন্যান্য প্রধান মতবাদে পুরাণের প্রতি এমন যুগপৎ মতবাদের প্রভাব কম। হিন্দু মতবাদে, ইতিহাসকে ক্ষণস্থায়ী আর অলীক হিসাবে দেখা হয় আর সে কারণে আধ্যাত্মিক বিবেচনায় গুরুত্বহীন। পুরাণের আদি মৌলিক পৃথিবীতে হিন্দুরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বৌদ্ধ মতবাদ গভীর মনোবৈজ্ঞানিক ধর্ম, এবং পুরাণকে মনোবিদ্যার প্রাচীন ধারা বলে মনে করে, দুটো বেশ সদৃশ। কনফুসিয়াসের মতবাদে, পুরাণের ভাষ্যের চেয়ে আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সবসময় বেশি। কিন্তু খ্রিস্টান, ইহুদি আর মুসলমানেরা বিশ্বাস করে ইতিহাসে তাদের ঈশ্বরের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে এবং এই পৃথিবীর বাস্তব ঘটনায় তাকে অনুভব করা সম্ভব। এসব ঘটনা কি আদতেই ঘটেছিল নাকি এগুলো সবই ‘পুরাণে’র অংশ? পুরাণের প্রতি এই অস্বস্তিকর মনোভাবের কারণে প্লাটো আর এ্যারিস্টোটলের হাত ধরে যা পশ্চিমা মননে প্রবেশ করেছে, একেশ্বরবাদীরা কিছু সময় পর পর দর্শনের যুক্তিপাতের সাথে ধর্মকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে চেষ্টা করাটা ভুল হয়েছে।