ইসরালইটসরা অবশ্য সুবিধামতো স্থানে মধ্যপ্রাচ্যের পুরাতন পুরাণ ব্যবহার করতে পারলে খুশীই হয়। যাত্রা পুস্তকে, আগাছাপূর্ণ সমুদ্র অতিক্রমের বর্ণনা দেয়া হয়েছে একটা পুরাণের আঙ্গিকে।[৮৬] অতিক্রমের আচার হিসাবে অপুদীক্ষা সনাতনভাবে প্রচলিত ছিল; অন্য দেবতারা পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে সমুদ্রকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন- যাত্রা পুরাণে অবশ্য পৃথিবীর বদলে মানুষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমরা যাকে দ্বিতীয় ইশায়াহ্ বলি, ষষ্ঠশতকের মাঝামাঝি নাগাদ যিনি ব্যাবিলনে সক্রিয় ছিলেন, তিনি পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীনভাবে একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত কর্কশ কিছু না; তার মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে ইয়াওয়েই একমাত্র ঈশ্বর; তার বিরুদ্ধ মনোভাব তিরোহিত হয়েছে। অবশ্য তার পরেও তিনি পুরাতন সৃষ্টি পুরাণের দ্বারস্থ হন যেখানে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য ইয়াওয়ে এই বিজয়কে নিষ্ক্রমণের সময় আগাছাপূর্ণ সমুদ্রকে দু’ভাগ করার সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। ইসরালাইটসরা এখন দিব্যশক্তির এমনই একটা প্রদর্শনী আশা করে যেখানে ঈশ্বর নির্বাসন রদ করে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। গিলগামেশের মহাকাব্যের ব্যাবিলনীয় লেখক প্রাচীন ইতিহাস আর পুরাণ এক করেছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় ইশায়াহ্ আরো এগিয়ে যায়। তিনি তার ঈশ্বরের আদিকালিক কর্মকাণ্ডকে বর্তমান ঘটনার সাথে জুড়ে দেন।[৮৭]
গ্রীসে, যুগান্তকারী সময়টা লোগোস (যুক্তি) দ্বারা তাড়িত, পুরাণ থেকে মনের বিভিন্ন স্তরে যা কাজ করে। আবেগ বা কোনো প্রকার আচার অনুষ্ঠানের সহযোগিতা যেখানে প্রয়োজন হয় পুরাণের মানে বুঝতে সেখানে লোগোস সতর্কতার সাথে যাচাই করে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যার আবেদন কেবল সমালোচক বুদ্ধিবৃত্তির কাছেই আছে। গ্রীক উপনিবেশ ইওনিয়ায় যা বর্তমান তুরস্ক, প্রথম পদার্থবিদ পুরাতন বিশ্ব পুরাণের যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে দেখার প্রয়াস নেন। অবশ্য এই বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা পুরাতন পৌরাণিক আর আদিরূপ কাঠামোর ভিতরেই আটকে থাকে। একদিক থেকে দেখতে গেলে এনুমা এলিশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যারা বিশ্বাস করত পৃথিবী কোনো আদিকালিক পদার্থ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কোনো দিব্য প্রচেষ্টা দ্বারা না, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্বাভাবিক নিয়মের কারণে এই রূপান্তর ঘটেছে। অ্যানাক্সিমানদারের কাছে (খ্রি: পূ: ৬১১-৫৪৭) মূল আর্চে (নীতি) আমাদের মানবিক অভিজ্ঞতার মতো কোনো ঘটনা না। তিনি এর নাম দেন অনন্ত, উষ্ণতা শীতলতার পর্যায়ক্রমিক পারস্পরিক ক্রিয়ায় আমাদের পরিচিত উপাদানগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। এ্যানাক্সিমেনেস (খ্রি: পূ: ৫০০) বিশ্বাস করতেন আর্চে হলো অনন্ত বাতাস; হেরাক্লিটাস (খ্রি: পূ: ৫০০) মনে করতেন আগুন। পুরাতন পুরাণের ন্যায় এসব প্রাথমিক ধারণার পুরোটাই কাল্পনিক, কারণ যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না। কবি জেনোফেনেসও (খ্রি: পূ: ৫৪০-৫০০) এটা উপলব্ধি করেন এবং মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন একটা যৌক্তিক ধর্মশাস্ত্র প্রণয়নের, দেবতাদের সম্বন্ধে প্রচলিত লোকায়ত পুরাণ নাকচ করে এবং phusikoi এর বিজ্ঞানের সাথে খাপ খায় এমন দেবতার অধিষ্ঠান করতে তিনি চেয়েছিলেন : বিমূর্ত, ছদ্মবেশী শক্তি, নৈতিক কিন্তু স্থির, সর্বজ্ঞ এবং শক্তিমান।
ইওনিয়ান পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে খুব কম লোকই আগ্রহ প্রকাশ করেছে যা ছিল গ্রীসের প্রথম যুগান্তকারী সত্তার প্রদর্শন। চতুর্থ শতকে দর্শনের প্রতি আগ্রহ জোরালো হবার আগে, এথেন্সবাসীরা একটা নতুন ধরনের কৃত্যানুষ্ঠানের প্রচলন করে, বিয়োগান্তক নাট্যকল্প, ধর্মীয় উৎসবের আবহে প্রাচীন পুরাণের ভাবগম্ভীর উপস্থাপন কিন্তু একই সাথে গভীরভাবে তাকে খুটিয়ে দেখার প্রয়াস। একিলাস (খ্রি: পূ: ৫২৫-৪৫৬) সফোক্লিস (খ্রি: পূ: ৪৯৬-৪০৫) এবং ইউরেপিডিস (৪৮০- ৪০৬) সবাই ঈশ্বরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, আর দর্শকেরা বিচারের ভূমিকায় আসীন। পুরাণ নিজেকে প্রশ্ন করে না, সে একপ্রকার আত্মপরিচয় দাবী করে। ট্রাজেডি অবশ্য সনাতন পুরাণ আর নিজের ভিতরে এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি করে এবং কয়েকটা মৌলিক গ্রীক মূল্যবোধের বিষয় খতিয়ে দেখে। দেবতারা কেনো ন্যায়পরায়ণ আর ঠিক? বীরত্ব, গ্রীকনেস বা গণতন্ত্রের মূল্য কি? নগর রাষ্ট্রের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে পুরাণ যখন পরাজয় মেনে নিচ্ছে ঠিক সেই সময়ে ট্রাজেডির আগমন ঘটেছে। অডিপাসের মতো বীর তখনও সনাতন পৌরাণিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচল কিন্তু তারা তাকে তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে না। পৌরাণিক বীরেরা যেমন যুদ্ধ করে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায় বা ন্যূনতম মাত্রায় হলেও দৃঢ়তা দেখাতে পারেন, ট্রাজিক বীরের ক্ষেত্রে সে ধরনের সমাধান প্রযোজ্য না। ব্যথা আর বিভ্রান্তির সাথে দোদুল্যমান অবস্থায়, নায়ককে সচেতনভাবে পছন্দ বেছে নিয়ে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।
প্রতিমা প্রথার বিরোধী হলেও, সনাতন রীতিতেই ট্রাজেডি লেখা হয়। কোনো ধর্মীয় আচারের ন্যায়, বিচ্ছিন্ন দুঃখকে ভাগ করে নেয়ার প্রয়াস এতে উপস্থাপিত কিন্তু প্রথমবারের মতো শহরের ধর্মীয় জীবনে অন্তরের ভাব সংযুক্ত হলো। ডিওনিসিসের উৎসবের সময় নাটক মঞ্চস্থ হতো এবং এথেন্সের যুবকদের উদ্দীপ্ত করতে আর তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। পরিচিত দীক্ষা অনুষ্ঠানের ন্যায়, ট্রাজেডি দর্শকদের অবর্ণনীয় আর চরম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করতো। উৎসর্গের আদর্শের ন্যায় অনেকটা যেহেতু এটা Katharsis-এর দিকে নিয়ে যেত, করুণা আর ভয়ের অনুভূতির দ্বারা হৃদয় ও মনকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে আত্মিক পরিশোধনে যার সমাপ্তি। কিন্তু উৎসর্গের এই নতুন রূপ অ্যাক্সিয়াল সমবেদনার সাথে সম্পৃক্তকরণ দর্শককে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে অনুভব করতে শিখাতো, আর এভাবে তাদের মানবতা আর সহানুভূতির পরিধির বিস্তার ঘটতো।