কিন্তু কনফুসিয়াসের কাছে, আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করাটা এসব পৌরাণিক গল্পের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৈদিক ভারতে একই অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়, সেখানে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গিত বলীর আচার অনুষ্ঠান মূল উদ্দেশ্যকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় চেতনা থেকে ধীরে ধীরে দেবতারা সরে যায় এবং খ্রিঃ পূঃ অষ্টম শতকের আচার অনুষ্ঠান সংস্কারকের দল নতুন প্রথা প্রবর্তন করে যেখানে ব্যক্তি একককে প্রাধান্য দেয়া হয়। সে কারণে মানুষ সাহায্যের জন্য দেবতাদের উপরে নির্ভর করতে পারে না, আচারের ক্ষেত্রে তাদের একটা আদর্শায়িত পৃথিবী সৃষ্টি করতে হবে নিজেদের জন্য। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্জিত ক্ষমতার যাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়, অভিজ্ঞতা এতটাই ব্যাপক যে মনে করা হতে থাকে যে দেবতার পরে পরম বাস্তবতার অবস্থান এবং সেটাই জগতের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। আজও, ধর্মীয় উৎসব তুরীয় আনন্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম তারা যাকে বলে অন্য মানস যা সাধারণ লোকায়ত চেতনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিধিবদ্ধ প্রথার প্রতি চীন আর ভারতবর্ষের গুরুত্ব আরোপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পুরাণকে তার প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা করে দেখাটা ঠিক না। পুরাণ এবং আচরিত অনুষ্ঠান সমান সমান অংশীদার, উভয়েই পবিত্রতার একটা অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং সাধারণত একই সাথে সেটা করে থাকে তবে কখনও কখনও অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যকে অতিক্রম করে যায়।
যুগান্তকারী ঋষিরা সবাই অবশ্য তৃতীয় আরেকটা উপাদানের কথা বলেছেন। পুরাণের আসল মানে বুঝতে হলে, কেবল আচারগুলো পালন করলেই চলবে না বা একে একটা আবেগঘন অনুরণন দান করে লাভ হবে না, সেইসাথে সঠিক নৈতিক আচরণও জরুরী। কনফুসিয়াস যাকে রেন, রাঙ আর শু বলেছেন সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত কারো প্রাত্যহিক জীবনে আচরিত না হবে ইয়াও বা শানের মতো পুরাণ ততক্ষণ পর্যন্ত বিমূর্ত অধরা রয়ে যাবে। বৈদিক ভারতে, আচার অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘কর্ম’।[৭৮] বুদ্ধের অবশ্য এধরনের উৎসর্গমূলক আচারে কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি কর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন আমাদের সাধারণ প্রতিক্রিয়াকে প্রেরণা দান করে যে ইচ্ছা সেটাই কর্ম। আমাদের প্রেষণা হলো অন্তরের কর্ম, মানসিক কর্ম আচারানুষ্ঠান পালনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বাহ্যিক কর্মের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাক্সিয়াল পর্বের এই সময়কাল বিশেষভাবে বৈপ্লবিক, যা নৈতিকতা এবং পুরাণ উভয়ের বোঝাপড়া আত্তীকরণে সাহায্য করে। পুরাণ সবসময়ে কর্ম দাবী করে। বৈপ্লবিক যুগের ঋষিরা বোঝাতে চেয়েছেন যে পুরাণের মূল অর্থ আমাদের সামনে প্রতিভাত হবে না যতক্ষণ না প্রাত্যহিক জীবনে ন্যায়বিচার এবং অপরের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের চর্চা আয়ত্তে না আসবে।
ডাও ডে জিঙের খ্রি: পূ: তৃতীয় শতকের লেখক, সনাতনভাবে তাকে লাওজি বলা হয়, প্রথাগত আচারঅনুষ্ঠানকে তিনিও বিরূপ দৃষ্টিতেই দেখছেন। লি’র পরিবর্তে তিনি মনঃসংযোগের অভ্যাসের উপর জোর দিয়েছেন যা অনেকটা ভারতীয় যোগব্যায়ামের মতো। তার স্থির বিশ্বাস ছিল, সভ্যতা একটা বিরাট ভুল, যা মানুষকে সত্যের পথ (ডাও) থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কৃষিজীবী সরলতার সোনালী দিনের দিকে পেছন ফিরে তাকান লাওজি, যখন মানুষ ছোট ছোট গ্রামে বাস করত, কোনো প্রযুক্তি ছিল না, ছিল না শিল্পকলা বা সংস্কৃতি, যুদ্ধও ছিল না।[৭৯] শেননঙ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর সাথে সাথে এই সোনালী দিনের যুগ শেষ হয়েছে বলে চীনারা বিশ্বাস করত, যিনি, নিজে অমানবিক পরিশ্রম করে মানুষকে কৃষিকাজ শিখিয়েছিল। শেননঙ সব উদ্ভিদ খেয়ে দেখেছে কেবল জানতে যে কোনটা সহজপাচ্য এবং সেটা করতে গিয়ে একবার একদিনে সত্তর বার বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিল। খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতক নাগাদ, যখন শক্তিশালী রাজারা ছোট ছোট রাজ্য আর গ্রাম একের পর এক বিধ্বংসী যুদ্ধে জয় করে নিচ্ছে তখন শেননঙের পুরাণ ভাষ্য বদলে যায়। তখন তাকে আদর্শ শাসক হিসাবে অভিহিত করা শুরু হয়। বলা হতে থাকে, একটা সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য তিনি শাসন করেছেন, যেখানে প্রজাদের পাশে মাঠে লাঙল চষেছেন, এবং কোনো মন্ত্রী বা আইন আর শাস্তির ভয় ব্যতীত তিনি শাসন কাজ পরিচালনা করেছেন। আদর্শবাদী তপস্বীর দল শেন নঙের আদর্শ পুনরায় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সামাজিক জীবন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং ডাও ডে জিঙ যা ছোটখাটো রাজ্যের নৃপতির উদ্দেশে লিখিত সেখানেও একই উপদেশ দেখা যায়। পিছু হটে আসাই উত্তম, অনাড়ম্বর জীবনযাপন কর এবং কুটোটিও নাড়িও না যতক্ষণ না মহান শক্তিগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে নিজেদের ধ্বংস না করছে।
কিন্তু অন্য সব যুগান্তকারী শিক্ষকের ন্যায়, লাওজি কেবল বেঁচে থাকার বাস্তবতা নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন না, কিন্তু পৃথিবীর উত্থানপতনের মাঝে একটা সর্বব্যাপী শান্তির উৎস খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন। পরম বাস্তবতার অভিকাঙ্ক্ষী হন তিনি, ডাও, যার ব্যাপ্তি দেবতাদেরও ছাড়িয়ে যায় এবং যা সব অস্তিত্বের অবর্ণনীয় ভিত্তি। আমরা যা কিছু ধারণা করতে পারি এটা তার সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় এবং তারপরেও যদি আমরা আমাদের ভিতরে একটা শূন্যতার চাষ করি, কোনো ধরনের স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা এবং লোভ ছাড়া সমবেদী জীবনযাপন করি তাহলে আমরা ডাও আত্মস্থ করতে পারব এবং এভাবেই রূপান্তর ঘটবে। আমরা যখন সভ্যতার লক্ষ্য কেন্দ্রিক মূল্যবোধ পরিত্যাগ করবো কেবল তখনই আমরা জীবন যেমন হওয়া উচিত তার সাথে খাপ খাওয়াতে পারবো।[৮০] আবার লাওজি যেমন শেননঙের পৌরাণিক সোনালী দিন কামনা করছেন আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে, তিনি সনাতন পুরাণের কাছেও আবেদন জানান (যা হয়তো এখনও বর্তমান সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়) ডাওকে জাগ্রত করতে। ডাও হলো জীবনের উৎস, নিখুঁত পূর্বপুরুষ এবং একই সাথে মা। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ মহান মাতাকে দেখতো চণ্ড এবং রুদ্ররূপে কিন্তু নতুন যুগান্তকারী সত্তা, লাওজি তার চরিত্রে করুণার গুণাবলী আরোপ করেন। তাকে নিঃস্বার্থপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয় যা সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতা থেকে অচ্ছেদ্য।[৮১] প্রাগৈতিহাসিক নারী ও পুরুষ ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে মাতৃজঠরে ফিরে যাবার অভিনয় করেছে কখনও কখনও, সভ্য মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে সেই একই ফিরে যাওয়া মূর্ত করে তুলতে চেয়েছে।