সর্বশেষ, প্রতিটি পুরাণই আমাদের নিজস্ব জগতের পাশাপাশি অবস্থিত আরেকটা প্রেক্ষাপটের কথা বলে এবং যা এক অর্থে আমাদের জগৎকে সমর্থন করে। এই অদৃশ্য কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী বাস্তবতায় বিশ্বাস স্থাপন, যাকে কখনও কখনও দেবতাদের পৃথিবী বলে অভিহিত করা হয়, পুরাণতত্ত্বের মূল আঙ্গিক। অনেক সময়ে একে বারোমেসে দর্শন হিসাবে অভিহিত করা হয় কারণ আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিকতার আগমনের পূর্বে সব সমাজব্যবস্থার সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং কৃত্যানুষ্ঠান, পুরাণতত্ত্বকে অবহিত করত এবং বর্তমানেও অনেক সনাতন সমাজকে প্রভাবিত করে চলেছে। বারোমেসে দর্শন অনুসারে, এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, সবকিছু যা আমরা এখানে দর্শন বা শ্রবণ করে থাকি, তার একটা প্রতিরূপ রয়েছে দিব্যলোকে যা আমাদের এখানের চাইতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী এবং অনেক বেশি স্থায়ী।[১] এবং প্রতিটি পার্থিব বাস্তবতা এর আদিরূপ, মূল ছাঁচের, জেলো সংস্করণ, ত্রুটিযুক্ত প্রতিরূপ। এই দিব্য জগতের অঙ্গীভূত হয়েই কেবল নশ্বর ভঙ্গুর মানুষ তাদের সম্ভাবনা সার্থক করে তুলতে পারে। মানুষ অন্তজ্ঞানে যা অনুভব করে পুরাণ তাকেই পরিপূর্ণ সুনির্দিষ্ট আকৃতি এবং রূপ দান করে। পুরাণ তাদের কাছে দেবতাদের আচরণ ব্যাখ্যা করে, অলস অনুসন্ধিৎসা থেকে না বা এসব আকর্ষণীয় শোনায় বলে না, যাতে এসব শক্তিশালী সত্তাকে মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে অনুকরণ করতে সক্ষম হয় এবং নিজেদের মাঝে দিব্যসত্তাকে অনুভব করতে পারে।
আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতিতে, আমরা প্রায়শই দৈবকে সাধারণ ভঙ্গিতে প্রকাশ করে থাকি। প্রাচীনকালে, ‘দেবতা’দের খুব কম সময়েই অসংলগ্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সম্পূর্ণ ভিন্ন বিমূর্ত অস্তিত্বে বসবাসকারী অতিপ্রাকৃতিক সত্তা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। আধুনিক মতে পুরাণতত্ত্ব ধর্মতত্ত্বের সাথে না বরং মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। মানুষ মনে করে যে দেবতা, মানুষ, জীবজন্তু এবং প্রকৃতি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ, একই নিয়মের অধীন এবং একই দিব্যসত্তা থেকে উদ্ভূত। শুরুতে দেবতাদের জগৎ আর মানুষের জগতের ভিতরে কোনো ধরনের অস্তিত্বের ফারাক বিদ্যমান ছিল না। মানুষ যখন দৈবের কথা বলতো তখন যেন তারা জাগতিক পৃথিবীর একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়েই আলোচনা করছে বলে মনে করতো। দেবতাদের অস্তিত্ব কোনো ঝড়, সাগর নদী থেকে বা মানুষের প্রচণ্ড অনভূতি- ভালোবাসা, ক্রোধ বা যৌন অনুভূতি থেকে অচ্ছেদ্য ছিল যা ক্ষণিকের জন্য যেন নারী পুরুষকে অস্তিত্বের একটা ভিন্ন স্তরে উন্নীত করতো যাতে করে জগৎকে তারা একটা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে সক্ষম হয়।
পুরাণতত্ত্ব আমাদের তাই মানবজীবনের সমস্যাসঙ্কুল দশার সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো করে প্রণীত হয়েছে। মানুষকে জগতে নিজের স্থান এবং তার যথাযথ পরিচিতি খুঁজে নিতে এটা সাহায্য করে। কোথা থেকে আমরা এসেছি এটা সবাই জানতে চায় কিন্তু আমাদের শুরুটা যেহেতু প্রাকইতিহাসের কুয়াশায় হারিয়ে গেছে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে পুরাণের জন্ম দিয়েছি যা ইতিহাসনির্ভর নয় কিন্তু পরিবেশ, প্রতিবেশী এবং প্রথা সম্পর্কে আমাদের বর্তমান অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করে। আমরা আরও আমাদের পরিণতি সম্পর্কে জানতে চাই, তাই আমরা গল্পের অবতারণা করেছি যা মৃত্যুপরবর্তী অস্তিত্বের কথা বলে- যদিও পরবর্তীকালে আমরা দেখব, খুব বেশি পুরাণে মানুষের জন্য অমরত্বের কথা বলা হয়নি। এবং আমরা সেইসব মহিমান্বিত মুহূর্ত ব্যাখ্যা করতে চাই যখন আমরা আপাতভাবে আমাদের সাধারণ সত্তার ঊর্ধ্বে উন্নীত হই। দেবতারা মানুষের এই অভিজ্ঞতার সীমানা অতিক্রম করাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেন। আমাদের সহজাত অনুভূতি বারোমেসে দর্শন ব্যাখ্যা করে যে চর্মচক্ষুতে আমরা নিজেদের যে পার্থিব জগতে দেখি তার অতিরিক্ত কিছু একটা রয়েছে।
আজকাল ‘পুরাণ’ দ্বারা এমন কিছু ব্যাখ্যা করা হয় যা সত্যি হতে পারে না। পাপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনীতিবিদ ‘মিথ’ বলে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেবেন, মানে, তেমনটা কখনও ঘটেনি। পৃথিবীর বুকে দেবতাদের হেঁটে বেড়াবার, সমাধি থেকে মৃতদের বের হয়ে আসবার বা শত্রুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে পছন্দের লোকদের পালাবার সুযোগ করে দেয়ার কথা আমরা যখন শুনতে পাই, সাথে সাথে এসব গল্পকে অবিশ্বাস্য প্রতিপাদন করা সম্ভব না বিধায় অসত্য বলে, তাদের আমরা নাকচ করে দেই। অষ্টাদশ শতক থেকে ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে; আসলে কি ঘটেছিল সে বিষয় আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রাক-আধুনিক যুগে, মানুষ যখন অতীত সম্পর্কে কিছু লিপিবদ্ধ করত তখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কোনো ঘটনার আসল তাৎপর্য। পুরাণ তেমনই কোনো ঘটনা, আপাতদৃষ্টিতে যা একদা সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু একই সাথে যা সবসময়েই ঘটে চলেছে। ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের কঠোর কালানুক্রমিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, এ ধরনের পুনরাবৃত্তি বর্ণনা করার মতো কোনো শব্দ আমাদের সঞ্চয়ে নেই, কিন্তু পুরাণতত্ত্ব এক ধরনের শিল্পমাধ্যম, মানবঅস্তিত্বে যা কিছু ধ্রুপদী সময়ের সীমা অতিক্রম করে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এলোমেলো ঘটনার বিশৃঙ্খল প্রবাহের ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করে এবং বাস্তবতার মূল অংশবিশেষ আমাদের সামনে তুলে ধরে।