হুদাইবিয়াহ্ ছিল আরেকটি বাঁক বদল। এতে করে বেদুঈনরা আরও অধিক মাত্রায় প্রভাবিত হয় আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারটি এক অপরিবর্তনীয় ধারায় পরিণত হয়। অবশেষে ৬৩০-এ কুরাইশরা যখন মুহাম্মদের(স:) এক গোত্রীয় মিত্রকে আক্রমণ করার মাধ্যমে চুক্তির লঙ্ঘন করল, দশ হাজার সদস্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন মুহাম্মদ(স:)। এই বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হবার পর বাস্তববাদী বলে এর তাৎপর্য বুঝতে পেরে কুরাইশরা পরাজয় মেনে নেয়, খুলে দেয় নগরীর দ্বার এবং বিনা রক্তপাতে মক্কা অধিকার করে নেন মুহাম্মদ(স:)। তিনি কাবার চারপাশের প্রতিমাসমূহ ধ্বংস করেন, একে একমাত্র ঈশ্বর আল্লাহ্র নামে আবার নিবেদন করেন; আর প্রাচীন পৌত্তলিক আচার হজ্জকে আব্রাহাম, হ্যাঁগার ও ইসমায়েলের কাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত করে একে ইসলামী তাৎপর্য দান করেন। কুরাইশদের কাউকেই মুসলিম হতে বাধ্য করা হয়নি, কিন্তু মুহাম্মদের(স:) বিজয়ে তাঁর বেশীরভাগ নীতিবান প্রতিপক্ষ, যেমন আবু সুফিয়ান, উপলব্ধি করেছিল যে, প্রাচীন ধর্ম ব্যর্থ হয়েছে। ৬৩২-এ মুহাম্মদ(স:) যখন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আয়েশার হাতে পরলোকগমন করেন, তখন আরবের প্রায় সকল গোত্র কনফেডারেট বা ধর্মান্তরিত মুসলিম হিসাবে উম্মাহ যোগ দিয়েছে। যেহেতু উম্মাহর সদস্যরা পরস্পরকে আক্রমণ করতে পারে না, সেহেতু গোত্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রতিহিংসা এবং পাল্টা প্রতিহিংসার দুষ্টচক্রের অবসান ঘটেছিল। একক প্রয়াসে যুদ্ধ বিধবস্ত আরবে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন মুহাম্মদ(স:)।
রাশিদুন (৬৩২-৬৬১)
মুহাম্মদের(স:) জীবন ও সাফল্যসমূহ চিরকাল মুসলিমদের আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে চলবে। এগুলো “মুক্তি অর্জনে”র ইসলামী অনুভূতি প্রকাশ করে যা কোনও “আদিপাপে’র প্রায়শ্চিত্ত,” যা আদম করেছিলেন এবং অনন্ত জীবনে প্রবেশ করার মধ্যে নয় বরং এমন একটা সমাজ নির্মাণে নিহিত যেখানে মানব জাতির জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটে। এটা মুসলিমদের কেবল ইসলামপূর্ব কালে বিরজিত রাজনৈতিক ও সামাজিক নরক থেকেই মুক্তি দেয়নি বরং তাদের এমন একটা প্রেক্ষিত দান করেছে যার আওতায় মুসলিমরা আরও সহজে মনপ্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পেরেছে, যা তাদের পরিপূর্ণতা দিতে পারে। মুহাম্মদের(স:) ঈশ্বরের কাছে নিখুঁত আত্মসমর্পণের আদর্শ উদাহরণে পরিণত হয়েছেন এবং আমরা দেখব, মুসলিমরা তাদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে এই পর্যায়ে উন্নীত হতে চায়। মুহাম্মদ(স:) কখনও অলৌকিক চরিত্র হিসাবে সম্মানিত হননি, কিন্তু তাঁকে আদর্শ মানব ( Perfect Man) বলে মনে করা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের কাছে তাঁর আত্মসমর্পণ এমন পরিপূর্ণ ছিল যে তিনি সমাজকে বদলে দিয়েছিলেন এবং আরবদের একসঙ্গে বসবাসে সক্ষম করে তুলেছিলেন। উৎপত্তিগতভাবে ইসলাম শব্দটিকে সালাম (শান্তি)র সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই প্রাথমিক বছরগুলোর ইসলাম প্রকৃতই ঐক্য এবং সমন্বয়কে উৎসাহিত করেছিল।
কিন্তু মুহাম্মদ(স:) এই সাফল্য অর্জন করেছিলেন এক ঐশী প্রত্যাদেশের গ্রহীতা হিসাবে। তাঁর জীবদ্দশায় ঈশ্বর তাঁকে বাণী পাঠিয়েছেন যার মাধ্যমে কুরান সৃষ্টি হয়েছে। যখনই মুহাম্মদ(স:) কোনও সঙ্কট বা দ্বিধার মুখোমুখি হয়েছেন, নিজের গভীরে প্রবেশ করেছেন তিনি এবং ঐশ্বরিক প্রেরণা সঞ্জাত সমাধান শ্রবণ করেছেন। এই দিক দিয়ে তাঁর জীবন দুর্ভেয় সত্তা আর পার্থিব জগতের ভীষণ বিভ্রান্তিকর ও বিব্রতকারী ঘটনাপ্রবাহের মাঝে অব্যাহত সংলাপের পরিচয় তুলে ধরে। সুতরাং কুরান সাধারণ মানুষের জীবন ও চলতি ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করেছে, রাজনীতিতে ঐশ্বরিক দিকনির্দেশনা আর আলো যোগ করেছে। কিন্তু মুহাম্মদের (সঃ) উত্তরাধিকারীগণ পয়গম্বর ছিলেন না, বরং তাঁদের নিজস্ব মানবীয় অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। কীভাবে তাঁরা নিশ্চিত করবেন যে মুসলিমরা এই পবিত্র আদেশের প্রতি সৃজনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সাড়া দান অব্যাহত রাখবে? তাদের শাসিত উম্মাহর আকার আরও বড় হবে এবং মদীনার ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটির তুলনায় ক্রমবর্ধমানহারে জটিল হয়ে উঠবে। মদীনায় সবাই সবাইকে চিনত, সেখানে অফিস-আদালত আর আমলাতান্ত্রিকতার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। মুহাম্মদের(স:) নতুন ডেপুটিরা (খলিফাহ্) সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রথম উম্মা মূলধারা কীভাবে বজায় রাখবেন।
মুহাম্মদের(স:) উত্তরাধিকারী প্রথম চারজন খলিফাহ্ এইসব কঠিন প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন। তাঁরা পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ সহচরদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং মক্কা ও মদীনায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা বাঁশিদুন, সঠিকপথে পরিচালিত খলিফাহ্ হিসাবে পরিচিত, তাঁদের শাসনকাল ছিল স্বয়ং পয়গম্বরের সময়ের মতই গঠনমূলক। মুসলিমরা এই সময় কালের উন্মাতাল, মহীয়ান আর করুণ ঘটনাবলীর পর্যালোচনার ভেতর দিয়ে নিজেদের সংজ্ঞায়িত করবে আর নিজস্ব থিয়োলজি গড়ে তুলবে।
পয়গম্বরের পরলোকগমনের পর নেতৃস্থানীয় মুসলিমদের উম্মাহর প্রকৃতি কি হওয়া উচিত সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। কেউ কেউ হয়ত বিশ্বাস করেনি যে আরবে যার নজীর নেই এমন একটা “রাষ্ট্র”, প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন আছে। কেউ কেউ মনে করেছে যেন প্রত্যেক গোত্রীয় গ্রুপের নিজস্ব ইমাম (নেতা) নির্বাচন করা উচিত। কিন্তু পয়গম্বরের সহচর আবু বকর এবং উমর ইবন আল-খাত্তাব যুক্তি দেখালেন যে, উম্মাহকে অবশ্যই একটি এক্যবদ্ধ সমাজ হতে হবে এবং পয়গম্বরের অধীনে যেমন ছিল, একজন মাত্র শাসক থাকতে হবে এর। কারও কারও বিশ্বাস ছিল যে মুহাম্মদ (স:) তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয় আলী ইবন আবি তালিবকে উত্তরাধিকারী হিসাবে দেখতে চাইতেন। আরবে, যেখানে রক্তের সম্পর্ক ছিল পবিত্র, এটা মনে করা হত যে গোত্রপতির গুণাবলী তাঁর উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় এবং কোনও কোনও মুসলিমের বিশ্বাস ছিল যে আলী মুহাম্মদের (স:) বিশেষ কারিশমার কোনও অংশ বহন কেেছন। কিন্তু যদিও আলীর ধার্মিকতা প্রশ্নাতীত ছিল, কিন্তু তিনি তখনও তরুণ এবং অনভিজ্ঞ; সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আবু বকর পয়গম্বরের প্রথম খলিফাহ্ নির্বাচিত হন।