মদীনায় এই মুসলিম সাফল্যের প্রধান বলী ছিল তিন ইহুদি গোত্র কায়নুকাহ্ নাদির এবং কুরাঈযাহ্, যারা মুহাম্মদকে(স:) ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল এবং স্বাধীনভাবে মক্কার সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলেছিল। শক্তিশালী সেনাদল ছিল তাদের এবং নিঃসন্দেহে মুসলিমদের জন্যে হুমকি স্বরূপ ছিল তারা, কেননা তাদের আবাসিক এলাকার অবস্থান এমন ছিল যে তাদের পক্ষে অনায়াসে আক্রমণকারী মক্কা-বাহিনীর সঙ্গে যোগদান বা পেছন থেকে উম্মাহকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল। ৬২৫-এ কায়নুকাহ্ যখন মুহাম্মদের(স:) বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ বিদ্রোহ পরিচালনা করে, আরবের রেওয়াজ অনুযায়ী তাদের মদীনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। নাদির গোত্রকে আশ্বস্ত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন মুহাম্মদ(স:), বিশেষ চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন তাদের সঙ্গে, কিন্তু যখন জানতে পেলেন যে তারাও তাঁকে গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করছে, নির্বাসিত করলেন তাদের। সেখানে তারা নিকটবর্তী খায়বরের ইহুদি বসতির সঙ্গে যোগ দেয় এবং উত্তরাঞ্চলীয় আরব গোত্রগুলোর মাঝে আবু সুফিয়ানের সমর্থন সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। মদীনার বাইরে নাদির আরও বেশী বিপজ্জনক বলে প্রতিভাত হয়, তো পরিখার যুদ্ধে, ইহুদি গোত্র কুরাঈযাহ্ যখন, মুসলিমরা একটা সময়ে পরাজিত হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছিল, মক্কার পক্ষ অবলম্বন করল, মুহাম্মদ ( স: ) একটুও দয়া দেখাননি। কুরাইযা সাতশত পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং গোত্রের নারী-শিশুদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়।
কুরাঈয়ার হত্যাকাণ্ড একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কিন্তু তাকে আমাদের বর্তমান সময়ের মানদণ্ডে বিচার করতে যাওয়া ভুল হবে। অত্যন্ত আদিম সমাজ ছিল এটা: মুসলিমরা সবে অস্তিত্বের বিনাশ থেকে রক্ষা পেয়েছে, মুহাম্মদ (স:) যদি কুরাঈয়াকে স্রেফ নির্বাসিত করতেন, তারা খায়ররে ইহুদি প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী করে তুলত, উম্মাহর ওপর আরও একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিত। সপ্তম শতকের আরবে কুরাঈযাহ্র মত বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি কোনও গোত্রপতি অনুকম্পা প্রদর্শন করবেন, এটা ছিল অপ্রত্যাশিত। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি খায়বরে এক ভায়াল বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল এবং মদীনায় পৌত্তলিক প্রতিপক্ষকে ক্ষান্ত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে, কেননা পৌত্তলিক নেতারা বিদ্রোহী ইহুদিদের মিত্র ছিল। জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ ছিল এটা, সবারই জানা ছিল যে ঝুঁকি অত্যন্ত ব্যাপক। সংগ্রামের ব্যাপারটি সামগ্রিকভাবে ইহুদিদের প্রতি কোনওরকম বৈরিতার ইঙ্গিত দেয় না, কেবল তিনটি বিদ্রোহী গোত্রের সঙ্গে শত্রুতা বুঝিয়েছে। কুরান ইহুদি পয়গম্বরদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ অব্যাহত রাখে এবং ঐশীগ্রন্থধারী জাতিসমূহের প্রতি সম্মান জানানোর তাগিদ দিয়েছে। ছোট ছোট ইহুদি গোত্রগুলো মদীনায় বসবাস অব্যাহত রাখে এবং পরবর্তীকালে ক্রিশ্চানদের মত ইহুদিরাও ইসলামী সাম্রাজ্য সমূহে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেছে। অ্যান্টি-সেমিটিজম একটা ক্রিশ্চান অভিশাপ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টি এবং পরবর্তী সময়ে আরব প্যালেস্টাইন হাতছাড়া হওয়ার পরেই কেবল মুসলিম বিশ্বে ইহুদি বিদ্বেষ প্রকট হয়ে ওঠে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে মুসলিমরা ইউরোপ থেকে ইহুদি মিথ আমদানি করতে বাধ্য হয়েছিল, প্রটোকলস অভ দ্য এল্ডার্স অভ যায়ন (Protocal of the Elders of Zion)-এর মত ভীষণ অ্যান্টি- সেমিটিক রচনার আরবী অনুবাদও করেছে, কারণ তাদের এমন কোনও নিজস্ব ট্র্যাডিশন ছিল না। ইহুদি জাতির প্রতি এই নতুন বৈরিতার কারণে আজকাল কোনও কোনও মুসলিম কুরানের সেইসব অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দেয় যেগুলোয় তিন ইহুদি গোত্রের বিরুদ্ধে মুহাম্মদের(স:) সংঘাতের প্রসঙ্গ আছে-তাদের কুসংস্কার বৈধ প্রমাণ করার জন্য। এইসব পঙক্তিকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে এনে তারা কুরানের বাণী এবং পয়গম্বরের দৃষ্টিভঙ্গি উভয়কেই বিকৃত করে, যাঁর জুডাইজমের প্রতি কোনও ঘৃণাবোধ ছিল না।
কুরাঈযাহর বিরুদ্ধে মুহাম্মদের(স:) নিষ্ঠুরতা পরিকল্পনা করা হয়েছিল সকল বৈরিতার দ্রুততর অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে। কুরান শিক্ষা দেয় যে যুদ্ধ এমন এক বিপর্যয় যে মুসলিমদের অবশ্যই সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্যে তাদের সাধ্য অনুযায়ী সবরকম কৌশল ব্যবহার করতে হবে।[১৮] আরব পৌনঃপুনিকভাবে সহিংস সমাজ ছিল এবং শান্তির লক্ষ্যে উম্মাহকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মুহাম্মদ (স:) পেনিনসুলায় যে ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আনার প্রয়াস পাচ্ছিলেন সে ধরনের পরিবর্তন কদাচিৎ রক্তপাত ছাড়া অর্জিত হয়। কিন্তু পরিখার যুদ্ধের পর, মুহাম্মদ (স:) যখন মক্কাকে অপদস্থ আর মদীনার প্রতিপক্ষকে দমন করেন, তার ধারণা জন্মে যে জিহাদ পরিত্যাগ করে শান্তি প্রয়াস চালানোর সময় হয়েছে। ৬২৮ এর মার্চে তিনি বেশ কিছু বেপরোয়া এবং সৃজনশীল প্রয়াস অবলম্বন করেন যার ফলে সংঘাতের অবসান ঘটে। তিনি হজ্জ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় যাবার ঘোষণা দেন এবং সফরসঙ্গী হবার জন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের আহ্বান জানান। যেহেতু তীর্থযাত্রীদের অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ছিল, মুসলিমদের তাই সরাসরি সিংহের ডেরায় গিয়ে নিজেদের বৈরী এবং ক্ষুদ্ধ কুরাইশদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়ার মত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা। তা সত্ত্বেও আনুমানিক একহাজার মুসলিম পয়গম্বরের সঙ্গে যোগ দিতে সম্মত হয় এবং তারা মক্কার পথে বেরিয়ে পড়েন। তাদের পরনে ছিল হজ্জের ঐতিহ্যবাহী শাদা পোশাক। কুরাইশরা যদি আরবদের কাবাহ্য় যেতে বাধা দেয় বা প্রকৃত তীর্থযাত্রীদের উপর আক্রমণ চালায় তাহলে সেটা উপাসনাগৃহের অভিভাবক হিসাবে তাদের পবিত্র দায়িত্বের অমর্যাদা হবে। কুরাইশরা অবশ্য তীর্থযাত্রীদল নগরীর বাইরে সহিংসতা নিষিদ্ধ এলাকায় পৌঁছার আগেই আক্রমণ চালানোর জন্য বাহিনী প্রেরণ করেছিল, কিন্তু মুহাম্মদ(স:) তাদের এড়িয়ে যান এবং কয়েকটি বেদুঈন মিত্রের সহায়তায় স্যাঙ্কচুয়ারির প্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হন, হুদাইবিয়া শিবির স্থাপন করে ঘটনাপ্রবাহের গতি দেখার অপেক্ষায় থাকেন। শেষ পর্যন্ত কুরাইশরা এই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের চাপে পড়ে উম্মাহর সঙ্গে একটা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। উভয় পক্ষের জন্যেই অজনপ্রিয় একটা পদক্ষেপ ছিল এটা। মুসলিমদের অনেকেই অ্যাকশনের জন্য ব্যাগ্র ছিল, তারা এই চুক্তিকে লজ্জাকর মনে করেছে, কিন্তু মুহাম্মদ(স:) শান্তি পূর্ণ উপায়ে বিজয় অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিলেন।