একথা সত্যি নয় যে সকল মসুলিমই একইরকমভাবে পাশ্চাত্যের প্রতি ঘৃণায় পরিপূর্ণ। আধুনিকীকরণের প্রাথমিক পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় বহু চিন্তাবিদ ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি মোহাচ্ছন্ন ছিলেন এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ প্রথম সারির প্রভাবশালী মুসলিম চিন্তাবিদদের কেউ কেউ আবার পশ্চিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট খাতামি এই প্রবণতার একজন নজীর মাত্র। ইরানি বুদ্ধিজীবী আবদোলকরিম সোরোশও তাই, খোমিনির সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন তিনি এবং যদিও প্রায়ই অধিকতর রক্ষণশীল মুজতাহিদদের কাছে অপদস্থ হয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ছিল তাঁর। সোরোশ খোমিনিকে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু তিনি তাঁর চেয়ে অনেক বেশী এগিয়েছেন। তাঁর মতে ইরানিরা এখন তিনটি পরিচয় বহন করে: প্রাক-ইসলামী, ইসলামী এবং পশ্চিমা, যার সঙ্গে অবশ্যই সমন্বয় সাধন করতে হবে। সোরোশ পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজম প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন চিরদিন মানুষের আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন হবে; তবে ইরানিদের তিনি শিয়া ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন। ইসলামকে অবশ্যই এর ফিক্হকে আধুনিক শিল্পনির্ভর বিশ্বকে ধারণ করার লক্ষ্যে বিকশিত করতে হবে এবং নাগরিক অধিকারের দর্শন সৃষ্টি আর একবিংশ শতাব্দীতে নিজের সম্পদ ধরে রাখার জন্যে অর্থনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভাবন ঘটাতে হবে।
সুন্নী চিন্তাবিদগণও অনুরূপ সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন। অজ্ঞতা থেকে ইসলামের প্রতি পাশ্চাত্যের বৈরিতা জন্ম নিয়েছে, একথা বিশ্বাস করেন টিউনিসিয়ার নির্বাসিত রেনেসাঁ পার্টির নেতা রশিদ আল-গানোচি (Rashid al-Ghannouchi)। খ্রিস্ট ধর্মের অশুভ অভিজ্ঞতা এর উদ্ভবের কারণ, যা চিন্তা আর সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করেছিল। নিজেকে তিনি “গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থী” বলে বর্ণনা করেন এবং ইসলাম ও গণতন্ত্রের মাঝে কোনও অসামজ্ঞস্যতা লক্ষ্য করেননি; কিন্তু পশ্চিমের সেক্যুলারিজমকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কেননা মানুষকে এভাবে বিভক্ত আর টুকরো করা যায় না। তাওহীদের মুসলিম আদর্শ দেহ এবং আত্মা, বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিকতা, নারী ও পুরুষ, নৈতিকতা ও অর্থনীতি, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দ্বৈততা অস্বীকার করে। মুসলিমরা আধুনিকতা চায়, কিন্তু সেটা আমেরিকা, ব্রিটেইন বা ফ্রান্স কর্তৃক চাপিয়ে আধুনিকতা দেয়া নয়। মুসলিমরা পশ্চিমের দক্ষ ও চমৎকার প্রযুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল; রক্তপাত ছাড়াই পশ্চিমে সরকার পরিবর্তনের উপায় দেখে বিমোহিত হয় তারা। কিন্তু মুসলিমরা যখন পশ্চিমা সমাজের দিকে চোখ ফেরায়, কোনও আলো দেখতে পায় না, হৃদয় আর আধ্যাত্মিকতার লেশমাত্র চোখে পড়ে না। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও নৈতিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে চায় এবং একই সময়ে পাশ্চাত্য-সভ্যতার সেরা কিছু বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে চায়। আল-আযহারের ডিগ্রিধারী এবং মুসলিম ব্রাদার কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সুন্নাহ্ অ্যান্ড শরিয়াহ্র বর্তমান পরিচালক ইউসুফ আবদাল্লাহ্ আল-কারাদাওয়ি অনুরূপ চিন্তার অংশীদার। তিনি মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে মুসলিম বিশ্বে সম্প্রতি আবির্ভূত গোঁড়ামি মানুষকে অপরাপর মানুষের অন্তর্দৃষ্টি আর দর্শন থেকে বঞ্চিত করার ভেতর দিয়ে হীনতর করবে। পয়গম্বর মুহাম্মদ (স:) বলেছিলেন তিনি ধর্মীয় জীবনে চরমপন্থা পরিহারকারী “মধ্যপন্থা” আনার লক্ষ্যে এসেছেন এবং আল- কারাদাওয়ি মনে করেন যে ইসলামী বিশ্বের কোথাও কোথাও চলমান চরমপন্থা মুসলিম চেতনার দূরবর্তী এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, হুদাইবিয়ায় কুরাইশদের সঙ্গে এক অজনপ্রিয় সন্ধিতে উপনীত হয়ে পয়গম্বর যেমন দেখিয়েছেন। এ এমন এক কৃতিত্ব কুরান যাকে “মহাবিজয়” বলেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাশ্চাত্যকে অবশ্যই মুসলিমদের তাদের ধর্ম অনুসরণ করে জীবন যাপনের অধিকার এবং যদি চায় তাদের রাজনীতিতে ইসলামী আদর্শ যোগ করার অধিকার মেনে নিতে হবে। তাদের বুঝতে হবে জীবনযাপনের নানান উপায় আছে। বৈচিত্র্য গোটা বিশ্বকেই লাভবান করে। ঈশ্বর মানুষকে বেছে নেয়ার অধিকার এবং ক্ষমতা দিয়েছেন এবং কেউ কেউ ইসলামী রাষ্ট্রসহ ধর্মীয় জীবনের পক্ষে মত দিতে পারে, অন্যরা যেখানে সেক্যুলার আদর্শের পক্ষপাতি।
“মুসলিমরা ধার্মিক হলে, পশ্চিমের জন্যে ভাল,” যুক্তি দেখিয়েছেন ক্বারাদাওয়ি, “তারা তাদের ধর্ম মেনে চলুক, আর নীতিবান হওয়ার প্রয়াস পাক।”[৪] একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন তিনি। বহু পশ্চিমাবাসী তাদের জীবনে আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতিতে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করেছে। তারা অবশ্যই প্রাক- আধুনিক ধর্মীয় জীবন ধারায় বা প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন করতে চায় না। কিন্তু একটা উপলব্ধি ক্রমশ বেড়ে উঠছে যে, সর্বোত্তম অবস্থায় ধর্ম মানুষকে শুভ মূল্যবোধ বিকাশে সাহায্য করেছিল। শত শত বছর ধরে ইসলাম মুসলিম চেতনার সম্মুখ সারিতে সামাজিক ন্যায়-বিচার, সাম্য, সহিষ্ণুতা আর বাস্তব সহমর্মিতার ধারণাকে স্থান দিয়ে এসেছে। মুসলিমরা সবসময় এইসব আদর্শ অনুসরণ করতে পারেনি এবং বারবার এগুলোকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহে ধারণ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু এগুলো অর্জনের সংগ্রাম শত শত বছর ধরে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার মুখ্য বিষয় রয়ে গেছে। পশ্চিমা জনগণকে অবশ্যই বুঝতে হবে, তাদের স্বার্থেও ইসলামের স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী থাকা প্রয়োজন। ইসলামের চরম ধরণগুলোর জন্যে পাশ্চাত্য পুরোপুরি দায়ী নয়, যা এমন এক সহিংসতার বিকাশ ঘটিয়েছে যার ফলে ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র অনুশাসন লঙ্ঘিত হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্য নিশ্চিতভাবেই এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে; মৌলবাদী দর্শনের মূলে নিহিত ভীতি ও হতাশা প্রশমিত করার জন্যে তার উচিত তৃতীয় খ্রিস্টীয় সহস্রাব্দে ইসলাম সম্পর্কে অধিকতর সঠিক উপলব্ধি গড়ে তোলা।
তথ্যসূত্র
৫. প্রতিরুদ্ধ ইসলাম (পৃষ্ঠা: ১৫৫-১৯৬)