পরিণাম দুঃখজনকভাবে অনুমানযোগ্য ছিল। আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষুদ্ধ এবং ন্যায়বিচারের জন্যে মরিয়া FIS-র জঙ্গী সদস্যরা গেরিলা সংগঠন দ্য আমর্ড ইসলামিক গ্রুপ (GIA) গঠনের জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং আলজিয়ার্সের দক্ষিণে পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। গণহত্যার একাধিক ঘটনায় কয়েকটি গ্রামের সকল অধিবাসীকে হত্যা করা হয়। সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী, সেক্যুলার ও ধার্মিকরাও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে ইসলামপন্থীরাই এই নৃশংসতার জন্যে পুরোপুরি দায়ী, কিন্তু আস্তে আস্তে নানা প্রশ্ন উচ্চারিত হতে থাকে যার ফলে এসত্য বেরিয়ে আসে যে আলজিরিয়ান সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ কেবল এতে মৌন সম্মতিই দেয়নি বরং GIA কে দোষারোপ করার উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ডেও অংশ নিয়েছিল। এখন সেখানে এক ভীতিকর অচলাবস্থা বিরাজ করছে। FLN এবং FIS উভয় পক্ষই সমাধানে আগ্রহী বাস্তববাদী আলোচনায় অনিচ্ছুক কট্টরপন্থীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রথম অভ্যূত্থানের সহিংসতা ধার্মিক-সেক্যুলারিস্টদের মাঝে পুরোদস্তুর সংঘাতের দিকে গড়িয়েছে। জানুয়ারি ১৯৯৫তে রোমান ক্যাথলিক চার্চ দুপক্ষকেই একত্রিত করার লক্ষ্যে রোমে এক সভার আয়োজন করে, কিন্তু যেরোয়ালের সরকার অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। একটা সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যায়। আরও ইসলামী সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে এবং এক সাংবিধানিক রেফারেন্ডামে সকল ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
আলজিরিয়ার দুঃখজনক ঘটনা অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্যে উদাহরণ হতে পারে না। দমন-পীড়ন হতাশ মুসলিম সংখ্যালঘু অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে যা ইসলামের প্রত্যেকটা মৌল উপাদানের পরিপন্থী। আগ্রাসী সেক্যুলারিজম এমন এক ধার্মিকতার জন্ম দিয়েছে যা প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের অপমান। এ ঘটনা পাশ্চাত্য যে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করার জন্যে এত উদগ্রীব সেই গণতন্ত্রের ধারণাকে কলুষিত করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হলেও যেন এর সীমাবদ্ধতা রয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দল আর গ্রুপের সম্পর্কে অজ্ঞ বলে দেখানো হয়েছে। মধ্যপন্থী FIS কে চরম সহিংস মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে এবং পশ্চিমা মনে সহিংসতা, বেআইনী তৎপরতা আর অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিভূ বলে স্থান পেয়েছে যা এ দফায় FLN-র সেক্যুলারিস্টরাই আসলে প্রকাশ করেছে।
কিন্তু পাশ্চাত্য পছন্দ করুক বা না করুক, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে FIS-এর প্রাথমিক সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে যে জনগণ কোনও না কোনও ধরনের ইসলামী সরকার দেখতে চায়। এ ঘটনা মিশর, মরক্কো এবং টিউনিসিয়ায় একটা স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ করেছে– যেখানে সেক্যুলারিস্ট সরকারগুলো দীর্ঘদিন ধরে তাদের দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মানুরাগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেক্যুলারিজমের প্রভাব ছিল প্রবল, ইসলাম চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল। এখন মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনও সেক্যুলারিস্ট সরকার অস্বস্তির সঙ্গে অনুভব করছে যে যদি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ইসলামী সরকার ক্ষমতায় এসে যেতেও পারে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, মিশরে ১৯৫০-র দশকে নাসের-বাদ যেমন জনপ্রিয় ছিল এখন ইসলাম তেমন জনপ্রিয়। ইসলামী পোশাক এখন সর্বত্র দৃশ্যমান; মুবারকের সরকার যেহেতু সেক্যুলারিস্ট, স্পষ্টতই স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে এটা। এমনকি সেক্যুলারিস্ট টার্কিতেও সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে যে প্রায় ৭০ শতাংশ জনগণ নিজেদের ধর্মপরায়ণ বলে দাবী করেছে এবং ২০ শতাংশ দৈনিক পাঁচ বার প্রার্থনা করার কথা জানিয়েছে। জর্ডানের জনগণ মুসলিম ব্রাদারহুডমুখী হচ্ছে আর প্যালেস্টাইনে নজর দিচ্ছে মুজামার দিকে, ওদিকে PLO ১৯৬০-র দশকে তুঙ্গে থাকলেও এখন একে অদ্ভুত, দুর্নীতিগ্রস্ত আর সেকেলে মনে হচ্ছে। মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোয় কয়েক দশকব্যাপী সোভিয়েত নিপীড়নের পর মুসলিমরা আবার তাদের ধর্মকে আবিষ্কার করছে। জনগণ সেক্যুলারিস্ট মতাদর্শগুলোর আশ্রয় নিয়ে দেখেছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় যা চমৎকার সাফল্য দেখিয়েছে, আপন ভূমিতে ক্রিয়াশীল ছিল তা। মুসলিমরা বর্ধিত হারে চাইছে তাদের সরকার ইসলামী নিয়মকানুনের অনুসারী হোক।
এটা ঠিক কী রূপ নেবে এখনও তা পরিষ্কার নয়। মিশরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম শরিয়াহকে রাষ্ট্রীয় আইন হিসাবে দেখতে চায় বলে মনে হচ্ছে, অন্যদিকে টার্কিতে মাত্র ৩ শতাংশ লোকের এই প্রত্যাশা। কিন্তু এমনকি মিশরেও উলেমাদের কেউ কেউ কৃষিভিত্তিক আইনবিধি শরিয়াহ্কে আধুনিকতার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের সমস্যা যে চরম হতে বাধ্য সে ব্যাপারে সচেতন। একেবারে ১৯৩০-র দশকেই রাশিদ রিদা এব্যাপারে সজাগ ছিলেন। কিন্তু কাজটা করা অসম্ভব, একথা বলা যাবে না।