অবশ্য সহস্রাব্দ শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমদের কেউ কেউ যেন এই পাশ্চাত্য পূর্ব-ধারণার অনুসারী হয়ে ওঠে এবং প্রথমবারের মত পবিত্র সহিংসতাকে অত্যাবশ্যক ইসলামী কর্তব্যে রূপান্তরিত করে। এই মৌলবাদীরা প্রায়শ: পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও উত্তর-উপনিবেশিককালের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে আল- সালিবিয়াহ্: ক্রুসেড বলে অভিহিত করে থাকে। ঔপনিবেশিক ক্রুসেড অপেক্ষাকৃত কম সহিংস হলেও এর প্রভাব মধ্যযুগীয় পবিত্র যুদ্ধগুলোর চেয়ে অনেক ভয়াবহ। শক্তিশালী মুসলিম বিশ্বকে নির্ভরশীল ব্লকে পরিণত করা হয়েছে এবং এক ত্বরান্বিত আধুনিকীকরণ কর্মসূচির আওতায় মুসলিম সমাজকে স্থানচ্যুত করে ফেলা হয়েছে। আমরা যেমন দেখেছি, সারা বিশ্বে সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের মানুষ পশ্চিমা আধুনিকতার প্রভাবের অধীনে বিচলিত হয়ে মৌলবাদ নামে অভিহিত যুদ্ধপ্রবণ এবং উপর্যুপরি অসহিষ্ণু ধার্মিকতার জন্ম দিয়েছে। আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতির ক্ষতিকর প্রভাব হিসাবে বিবেচিত বিষয়াবলীর সংশোধনের প্রয়াস চালাতে গিয়ে মৌলবাদীরা পাল্টা লড়াই করে এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা সহানুভূতি ন্যায়বিচার আর মহানুভবতা যা ইসলামসহ সকল ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য– সেসব মৌলমূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যায়। মানুষের অন্য যেকোনও কর্মকাণ্ডের মত ধর্মও প্রায়শ অপব্যবহৃত হয়; কিন্তু নির্মলরূপে তা মানুষের মাঝে পবিত্র অলঙ্ঘনীয়তার অনুভূতি জাগাতে সাহায্য করার মাধ্যমে আমাদের প্রজাতির সহিংস প্রবণতা দূর করে থাকে। অতীতে ধর্ম নৃশংসতার জন্ম দিয়েছে; কিন্তু সেক্যুলারিজমের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এর সহিংস হওয়ার ক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা যেমন দেখেছি, সেক্যুলার আক্রমণ এবং নিপীড়ন প্রায়ই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে।
১৯৯২-তে আলজিরিয়ায় এটা করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭০-র দশকের ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সময় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (FIS) সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী দল দ্য ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (FLN) স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। FLN ১৯৫৪-তে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয় এবং ১৯৬২ তে দেশে একটি সমাজতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজিরিয়দের বিপ্লব ইউরোপ থেকে মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত আরব ও মুসলিমদের অনুপ্রেরণার কাজ করেছিল। FLN সেই সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সেক্যুলার ও সেক্যুলারিস্ট সরকারেরই অনুরূপ ছিল, যারা পশ্চিমা কায়দায় ইসলামকে ব্যক্তিপর্যায়ে অবনমিত করেছে। অবশ্য ১৯৭০-র দশক নাগাদ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জনগণ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ এইসব সেক্যুলারিস্ট আদর্শবাদের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে। FIS-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্বাস মাদানি আধুনিক বিশ্বের উপযোগি একটা ইসলামী রাজনৈতিক আদর্শ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন: আলজিয়ার্সের দরিদ্র এলাকার এক মসজিদের ইমাম আলী ইবন হাজ্জ FIS-র অধিকতর চরমপন্থী অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধীরে ধীরে FIS সরকারের অনুমোদন না নিয়েই নিজস্ব মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছিল; ফ্রান্সের মুসলিম জনগণের মাঝে এটা শেকড় গেড়ে বসে, শ্রমিকরা যেখানে কারখানা আর অফিসে প্রার্থনার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গার বরাদ্দের দাবী তুলে জাঁ-মেরি লে পেনের নেতৃত্বাধীন ডানপন্থীদলের রোষের শিকারে পরিণত হচ্ছিল।
১৯৮০-র দশক নাগাদ অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হয় আলজিরিয়া। FLN দেশটিকে গণতান্ত্রিক পথে চালু করে রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, কিন্তু সময়ের প্রবাহে তা হয়ে উঠেছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। পুরনো ‘গার্ডে অধিকতর গণতান্ত্রিক সংস্কার কার্যক্রমে অনীহ ছিল। আলজিরিয়ায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটে, তিরিশ মিলিয়ন অধিবাসীর অধিকাংশই ছিল অনুর্ধ্ব তিরিশ বছর বয়স্ক, অনেকেই ছিল বেকারত্বের শিকার, আবাসনের সঙ্কটও ছিল তীব্র। দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লেগেই থাকত। অচলাবস্থা আর FLN-র অদক্ষতার কারণে হতাশ তরুণ প্রজন্ম নতুন কিছু চেয়েছিল এবং নজর দিয়েছে ইসলামী দলগুলোর দিকে। ১৯৯০-র জুনে FIS স্থানীয় নির্বাচনে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিপুল বিজয় অর্জন করে। অধিকাংশ FIS কর্মী ছিল তরুণ, আদর্শবাদী এবং সুশিক্ষিত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোঁড়া আর রক্ষণশীল হিসাবে গণ্য হলেও সরকারে তারা ছিল সৎ এবং দক্ষ। নারীদের জন্যে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ব্যাপারে জোর দিত তারা। কিন্তু FIS পাশ্চাত্য বিরোধী ছিল না। নেতৃবৃন্দ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও পশ্চিমা বিনিয়োগে উৎসাহ দানের কথা বলতেন। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনী বিজয়ের পর ১৯৯২তে অনুষ্ঠেয় আইন পরিষদের নির্বাচনেরও নিশ্চিত জয়লাভের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছিল তাদের।
কিন্তু আলজিরিয়ায় কোনও ইসলামী সরকার আসতে পারেনি। সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান সংঘটিত করে উদাহরপন্থী FIS প্রেসিডেন্ট বেনিয়েদিদকে ( Beniedid) (যিনি গণতান্ত্রিক সংস্কার কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন) উৎখাত এবং FIS-কে দমন এবং এর নেতৃবৃন্দকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। পাকিস্তান বা ইরানে যদি এমন সহিংস এবং অসাংবিধানিক উপায়ে নির্বাচন বানচাল করা হত, শোরগোল পড়ে যেত পশ্চিমে। এধরনের অভ্যূত্থানকে গণতন্ত্রের প্রতি ইসলামের জন্মগত বিরূপতা, আর আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে চলার মৌলিক অযোগ্যতার উদাহরণ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু যেহেতু অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা ইসলামী সরকারকে বাদ দেয়া গেছে সেকারণে পশ্চিমা সংবাদপত্রে আনন্দের সুর ধ্বনিত হয়েছে। আলজিরিয়া ইসলামী ভীতি থেকে রক্ষা পেয়েছে; আলজিয়ার্সের বার, ক্যাবারে ডিসকোথেকগুলো বেঁচে গেছে; এবং কোনও রহস্যময় উপায়ে এই অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ আলজিরিয়াকে গণতন্ত্রের পক্ষে নিরাপদ করে তুলেছে। ফরাসি সরকার নতুন কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট লিয়ামিন যেরোয়ালের (Liamine Zeroual) FLN-র প্রতি সমর্থন দেয় এবং FIS-র সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় অস্বীকৃতিকে জোরদার করে। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মুসলিম বিশ্ব পশ্চিমাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের এই নতুন নজীর দেখে প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল।