ভারতে ১৯৪৭-এ সেসব মুসলিম পাকিস্তানে অভিবাসী হয়নি তাদের বংশধরগণের সংখ্যা এখন ১১৫ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সংখ্যার বিশালত্ব সত্ত্বেও অনেকেই নিজেদের পাশ্চাত্যবাসী ভাই-বোনের চেয়ে বেশী দল-বিচ্ছিন্ন এবং বিপদাপন্ন বলে মনে করে। ভারতের হিন্দু ও মুসলিম জনগণ এখনও ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের সময়ে সংঘটিত দুঃখজনক সহিংসতার স্মৃতিতে তাড়িত হয়; এবং হিন্দুদের অনেকেই ভারতে মুসলিম অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও মুসলিমরা সংবাদপত্রের অপপ্রচারের শিকার হয়। তাদের বিরুদ্ধে সংকীর্ণ মানসিকতার অভিযোগ আনা হয়, মনে মনে পাকিস্তান বা কাশ্মীরের প্রতি আনুগত্য পোষণের অভিযোগ ওঠে; অধিক সন্তান ধারণের জন্যে দোষারোপ করা হয় তাদের, পশ্চাদপদ থাকার জন্যে নিন্দা কুড়োয় তারা। ভারতীয় মুসলিমদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সহজে ভাল চাকুরি জোগাড় করতে পারে না তারা এবং প্রায়ই শোভন বসবাসের অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়। গৌরব-উজ্জ্বল মোঘল আমলের একমাত্র চিহ্ন হিসাবে রয়ে গেছে সুবিশাল দালান-কোঠাসমূহ: তাজ মহল, লাল কেল্লা আর জুনেহ্ মসজিদ, যেগুলো আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পদচারণাস্থলে পরিণত হয়েছে, যাদের দাবী: এগুলো আসলে হিন্দুরা নির্মাণ করেছিল আর মুসলিমরা ভারতের মন্দির ধ্বংস করে সেগুলোর জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করেছে। বিজেপির মূল লক্ষ্য ছিল বাবরী মসজিদ-মোঘুল অযোধ্যায় মোঘুল বংশের প্রতিষ্ঠাতা কর্তৃক নির্মিত মসজিদ-বিজেপি ১৯৯২-র ডিসেম্বরে মাত্র দশ ঘন্টার মধ্যে এটা ভূমিস্মাৎ করে, সংবোদিক আর সেনাবাহিনী নিশ্চল দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করে মাত্র। ভারতীয় মুসলিমদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ। তারা আতঙ্কিত বোধ করেছে একথা ভেবে যে এই প্রতীকী ধ্বংস আরও ব্যাপক ঝামেলার লক্ষণ মাত্র এবং অচিরেই তাদের স্মৃতিসমূহ ভারতের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার এই শঙ্কা দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’র প্রবল বিরোধিতার পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিল, যাকে ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আরও একটি বড় ধরনের হুমকি বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও অসহিষ্ণুতা ভারতীয় ইসলামের অত্যন্ত সহিষ্ণু এবং সভ্য ঐতিহ্যর পরিপন্থী। আতঙ্ক আর নিপীড়ন আরও একবার ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃত করেছে।
আগামীর সম্ভাবনা
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রাক্কালে ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে প্রায় তিরিশ হাজার ইহুদি এবং মুসলিমকে হত্যা করেছিল, প্রাণবন্ত ইসলামী পবিত্র নগরীকে পরিণত করেছিল গন্ধময় চারন্যাল হাউজে। অন্তত পাঁচ মাস ধরে নগরীর আশপাশের উপত্যকা আর খানাখন্দগুলো গলিত লাশে পরিপূর্ণ ছিল, অভিযানের পরবর্তী পর্যায়ে নগরীতে রয়ে যাওয়া ক্রুসেডারদের সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়ায় তাদের পক্ষে এসব লাশ সরিয়ে ফেলার কোনও উপায় ছিল না। গোটা জেরুজালেম হয়ে উঠেছিল দুর্গন্ধময়, যেখানে আব্রাহামের তিনটি ধর্মই ইসলামী শাসনের অধীনে প্রায় পাঁচ শত বছর অপেক্ষাকৃত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভেতর সহাবস্থান করছিল। এটাই ছিল ক্রিশ্চান-পশ্চিম সম্পর্কে মুসলিমদের প্রথম অভিজ্ঞতা। পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর নেমে আসা অন্ধকার যুগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তখন বেরিয়ে এসেছিল পাশ্চাত্য, আবার উপস্থিত হয়েছিল বিশ্ব পরিমণ্ডলে। মুসলিমরা ক্রুসেডারদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু খুব বেশী দিন তাদের উপস্থিতির কারণে বাধা পড়ে থাকেনি। ১১৮৭-তে সালাদিন ইসলামের পক্ষে জেরুজালেমকে পুনর্দখল করতে সক্ষম হন এবং যদিও ক্রুসেডাররা আরও প্রায় শত বছর নিকটপ্রাচ্যে অবস্থান করেছে, কিন্তু এই অঞ্চলের দীর্ঘ ইসলামী ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তাদের একটা গুরুত্বহীন তুচ্ছ অধ্যায় বলে মনে হয়েছে। ইসলামী জগতের অধিকাংশ অধিবাসী ক্রুসেডের প্রভাব বলয়ের বাইরে রয়ে গিয়েছিল এবং পশ্চিম ইউরোপের প্রতি অনাগ্রহী রয়ে গেছে, যা ক্রুসেডীয় সময়ে নাটকীয় সংস্কৃতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশী পেছনে পড়েছিল।
কিন্তু ইউরোপীয়রা ক্রুসেডের কথা বিস্মৃত হয়নি, তারা দার আল-ইসলামকে অগ্রাহ্যও করতে পারেনি; যা কিনা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্ব শাসন করতে যাচ্ছে বলে প্রতিভাত হচ্ছিল। এমনকি ক্রুসেডের সময় থেকেই পশ্চিমা-ক্রিশ্চান জগতের মানুষ ইসলামের এক স্টেরিওটিপিক্যাল এবং বিকৃত ইমেজ সৃষ্টি করে নিয়েছিল যেখানে ইসলামকে সুশীল সভ্যতার প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখা হয়। এই সংস্কার ক্রুসেডের অপর শিকার ইহুদিদের সম্পর্কে ইউরোপীয় কল্প কথার সঙ্গে মিশে গেছে এবং ক্রিশ্চানদের আচরণে প্রায়ই তা সুপ্ত উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটায়। যেমন উদাহরণস্বরূপ, ক্রুসেডের সময় ক্রিশ্চানরাই যেখানে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একাধিক নৃশংস পাবত্র যুদ্ধের সূচনা করেছিল, তখন ইউরোপের শিক্ষিত পণ্ডিত-মনস্করাই ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে সহিংস এবং অসহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাস হিসাবে বর্ণনা করেছে যা কিনা কেবল তরবারির সাহায্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের কল্পিত গোড়ামিপূর্ণ অসহিষ্ণুতার কিংবদন্তী পাশ্চাত্যের অন্যতম বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে।