কিন্তু এটা প্রতীয়মান হয় যে ইসলামী বিপ্লব হয়ত ইরানি জনগণকে তাদের মত করে আধুনিকতায় উত্তোরণে সাহায্য করেছে। পরলোকগমনের কিছুদিন আগে খোমিনি সংসদের কাছে আরও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়াস পান এবং তাঁর স্পষ্ট আশীর্বাদে মজলিসের স্পিকার হাশেম রাফসানজানি বেলায়েত-ই ফাকিহর এক গণতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেন। আধুনিক রাষ্ট্রের চাহিদাসমূহ শিয়াদের গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করেছে, কিন্তু এযাত্রায় সেটা এসেছে ইসলামী প্যাকেজ হিসাবে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে একে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। মে ২৩, ১৯৯৭তে হোজ্জাত ওল-ইসলাম সায়ীদ খাতামি ভূমিধস বিজয় অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। অবিলম্বে তিনি স্পষ্ট করে দেন যে পাশ্চাত্যের সঙ্গে আরও ইতিবাচক সম্পর্কে গড়ে তুলতে আগ্রহী তিনি এবং সেপ্টেম্বর ১৯৯৮তে রুশদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত ফাতওয়াহর সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্ক না থাকার ঘোষণা দেন যা পরে ইরানের প্রধান ফাকিহ্ আয়াতোল্লাহ আলী খামেনীর অনুমোদন লাভ করে। খাতামির নির্বাচন জনগণের এক বিপুল অংশের বহুত্ববাদ, ইসলামী আইন-কানুনের কোমল ব্যাখ্যা, অধিকতর গণতন্ত্র এবং নারীদের জন্যে আরও প্রগতিশীল নীতির পক্ষে জোরাল আকাঙ্ক্ষার সঙ্কেতবাহী ছিল। যুদ্ধে এখনও বিজয় অর্জিত হয়নি। খোমিনির বিরোধিতাকারী রক্ষণশীল পুরোহিত, যাদের প্রতি তিনি গুরুত্ব দেননি, এখনও খাতামির বহু সংস্কারকে রুখে দিতে সক্ষম, কিন্তু কুরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত অথচ বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম একটি টেকসই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ এখনও ইরানি জনগণের প্রধান অগ্রাধিকার রয়ে গেছে।
সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলিম
ইসলামী মৌলবাদের অপচ্ছায়া গোটা পাশ্চাত্য সমাজে কাঁপুনি ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার্কে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের একই রকম প্রবল ও সহিংস মৌলবাদের দ্বারা ততটা শঙ্কিত বলে মনে হয় না। এটা নিশ্চিতভাবেই তাদের নিজের দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের প্রতি পাশ্চাত্যের জনগণের আচ প্রভাবিত করেছে। ইউরোপে পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন মুসলিম বাস করে, অ * থেকে আট মিলিয়নের অধিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। জার্মান ও ফ্রান্সে এখন প্রায় হাজারখানেক মসজিদ আছে, যুক্তরাজ্যে এর সংখ্যা পাঁচ শত। পাশ্চাত্যবাসী মুসলিমদের অর্ধেকেরই জন্ম হয়েছে সেখানে, যাদের বাবা-মা ১৯৫০ ও ১৯৬০-র দশকে অভিবাসী হয়েছিল। তারা তাদের অভিভাবকদের নরম অবস্থান প্রত্যাখ্যান করেছে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং বৃহত্তর পরিসর ও স্বীকৃতির সন্ধান করছে। কখনও কখনও ভ্রান্ত পরামর্শে অগ্রসর হয় এরা, যেমন উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০-র দশকে যুক্তরাজ্যে মুসলিমদের জন্য ডক্টর কলিম সিদ্দিকীর পৃথক পার্লামেন্ট গঠনের আহ্বান। এই প্রকল্প ব্রিটিশ মুসলিমদের খুব নগণ্য সমর্থন লাভ করেছিল, কিন্তু মুসলিমরা সমাজের মূলধারায় নিজেদের একীভূত করতে ইচ্ছুক নয় ভেবে শঙ্কিত বোধ করেছে লোকে। দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’কে নিয়ে সঙ্কটকালেও মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ব্যাপক বৈরী আচরণ দেখা গেছে, মুসলিমরা যখন ব্র্যাডফোর্ডে গ্রন্থটি পুড়িয়েছিল। অধিকাংশ ব্রিটিশ মুসলিম হয়ত উপন্যাসটিকে অনুমোদন দেয়নি, কিন্তু রূশদীর মৃত্যু দেখারও ইচ্ছা ছিল না তাদের। ইউরোপীয়দের পক্ষে যেন স্বদেশী মুসলিমদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক নির্মাণ কঠিন ঠেকে। অভিবাসী টার্কিশ শ্রমিকরা জার্মানির বর্ণ-দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে আর হিজাব বেছে নেয়া স্কুলছাত্রীদের নিয়ে ফরাসি সংবাদপত্রসমূহে বৈরীভাবাপন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনে মুসলিমরা তাদের সন্তানদের জন্যে পৃথক স্কুল প্রতিষ্ঠার অনুরোধ তুললে ক্ষোভ দেখা যায়, অথচ ইহুদি, রোমান ক্যাথলিক বা কুয়েকারদের জন্য বিশেষ স্কুলের বেলায় কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করে না। মুসলিমদের যেন পঞ্চম বাহিনী হিসেবে দেখা হয়, ব্রিটিশ সমাজকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে যেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের অবস্থান অনেকটা ভাল। মুসলিম অভিবাসীরা এখানে শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত পর্যায়ের। তারা চিকিৎসা, শিক্ষকতা, প্রকৌশল পেশায় নিয়েজিত, যেখানে ইউরোপে মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনও প্রবলভাবে শ্রমিক শ্রেণীর। আমেরিকান মুসলিমরা মনে করে তারা স্বেচ্ছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে। তারা আমেরিকান হতে চায়। সংমিশ্রণের পরিবেশে ইউরোপের তুলনায় এখানে সে সম্ভাবনা অনেক বেশী। কোনও কোনও মুসলিম, যেমন ম্যালকম এক্স (১৯২৫-৬৫), দ্য নেশন অভ ইসলাম নামে পরিচিত কৃষাঙ্গ বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের ক্যারিশম্যাটিক নেতা, মানবাধিকার আন্দোলন চলাকালে ব্যাপক মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন; কৃষ্ণাঙ্গ ও মুসলিম শক্তির এক প্রতাঁকে পরিণত হন তিনি; কিন্তু নেশন অভ ইসলাম একটা হিটারোডক্স পার্টি ছিল। ১৯৩০-এ ডেট্রয়টের এক পেডলার ওয়ালেস ফার্ড কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯৩৪-এ ফার্ডের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর, এলিজাহ্ মুহাম্মদের (১৮৯৭-১৯৭৫) নেতৃত্বাধীন এই দল দাবী করে যে ঈশ্বর ফার্ডের দেহ ধারণ করেছেন, শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই অশুভ এবং মৃত্যুর পরে অন্য কোনও জীবনের অস্তিত্ব নেই– এসবই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মদ্রোহী। দ্য নেশন অভ ইসলাম আফ্রিকান আমেরিকানদের বহু বছর ক্রীতদাস করে রাখার ক্ষতিপূরণ হিসাবে পৃথক রাষ্ট্রের দাবী করেছিল; পাশ্চাত্যের প্রতি প্রবল বৈরীভাবাপন্ন ছিল দলটি। অবশ্য এলিজাহ্ মুহাম্মদের নৈতিক স্খলন আবিষ্কার করে ম্যালকম এক্স দ্য নেশন অভ ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং অনুসারীদের নিয়ে সুন্নী ইসলামে যোগ দেন: এর দুবছর পরে, দল ত্যাগের অপরাধে নিহত হন তিনি। কিন্তু দ্য নেশন অভ ইসলাম আজও ম্যালকম-এক্স প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান মুসলিম মিশনের তুলনায় ঢের বেশী মিডিয়া কাভারেজ পাচ্ছে; আমেরিকান মুসলিম মিশন এখন পুরোপুরি অর্থোডক্স: শিক্ষালাভের জন্যে সদস্যদের আল-আয্হারে পাঠাচ্ছে এবং অধিকতর ন্যায়-বিচার ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের পাশাপাশি কাজ করার সম্ভাবনার অনুসন্ধান করছে। নেশনের অস্বাভাবিক ও প্রত্যাখ্যানমূলক অবস্থান ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে অসহিষ্ণু এবং গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্ম-বিশ্বাস কল্পনা করার পশ্চিমা স্টেরিওটাইপের নিকটবর্তী বলে মনে হতে পারে।