প্রায় সময়ই মানুষ আধুনিক ধ্যানধারণা ও উদ্দীপনাসমূহকে বোধগম্য করে তোলার কাজে ধর্মের ব্যবহার করে থাকে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, ১৭৭৬-এর আমেরিকান বিপ্লবের সময় সকল আমেরিকান ক্যালভিনিস্ট ফাউন্ডিং ফাদারদের সেক্যুলারিস্ট আদর্শ অনুসরণ বা এমনকি বুঝতও না। তারা সংগ্রামকে একটা খ্রিস্টীয় রঙ দিয়েছিল যাতে জনগণ সেক্যুলারিস্টদের পাশাপাশি একটা নতুন পৃথিবী সৃষ্টির লক্ষ্যে লড়তে পারে। শিয়া ও সুন্নী মৌলবাদীদের কেউ কেউও আধুনিক সংস্কৃতির অচেনা সুরকে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে ধর্মকে ব্যবহার করছে, একে আরও সুগম করে তোলার জন্যে অর্থের ও আধ্যাত্মিকতার একটা প্রেক্ষিত দিচ্ছে। আবার, তারা আভাসে জানিয়ে দিচ্ছে যে, পাশ্চাত্য নির্ধারিত শর্তের বাইরেও ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেও আধুনিক হওয়া সম্ভব। ১৯৭৮-৭৯’র ইরানি বিপ্লবকে এই আলোয় দেখা যেতে পারে। ১৯৬০-র দশকে আয়াতোল্লাহ্ রুহোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) মুহাম্মদ রেযা শাহ্-র বর্বর এবং অসাংবিধানিক নীতিমালার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্যে ইরানের জনগণকে রাজপথে বের করে এনেছিলেন। রেযা শাহকে কারবালায় হুসেইনের মৃত্যুর জন্যে দায়ী উমাইয়াহ্ খলিফা ইয়াযিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি- শিয়া ইসলামে অন্যায়প্রবণ শাসকের উদাহরণ। এই ধরনের একনায়কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা মুসলিমদের দায়িত্ব। জনগণ, যারা হয়ত সোস্যালিস্টদের বিপ্লবের আহ্বানে আলোড়িত হত না, খোমিনির ডাকে সাড়া দিয়েছিল, যা তাদের গভীরতম ট্র্যাডিশনে অনুরণন তুলেছিল। শাহ্-র সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের শিয়া বিকল্পের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন খোমিনি। তাঁকে যেন বেশী বেশী করে একজন ইমামের মত মনে হচ্ছিল। সকল ইমামের মত আক্রান্ত হয়েছেন তিনি, কারারুদ্ধ হয়েছেন এবং অন্যায়কারী শাসকের হাতে নিহত হতে যাচ্ছিলেন প্রায়; কোনও কোনও ইমামের মত নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি এবং তাঁকে আপন অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়েছে; আলী এবং হুসেইনের মত সাহসিকতার সঙ্গে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তিনি এবং প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের পক্ষ নিয়েছেন, সকল ইমামের মত সক্রিয় অতীন্দ্রিয়বাদী হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি; হুসেইনের মত, যাঁর পুত্রকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছিল, খোমিনির পুত্র মুস্তাফাঁকে শাহ্-র লোকেরা হত্যা করেছিল।
আধা সরকারী পত্রিকা এত্তেলাত-এ খোমিনির নামে বানোয়াট অপমানকর আক্রমণ এবং এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসা তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যার পর ১৯৭৮-এ বিপ্লবে সূচিত হলে খোমিনি যেন গোপন ইমামের মত দূর থেকে (তার নির্বাসন স্থান নাজাফ) আন্দোলন পরিচালনা করছেন বলে মনে হয়েছে। সেক্যুলারিস্ট আর বুদ্ধিজীবীরাও উলেমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন, কেননা তারা জানতেন যে খোমিনিই তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সমর্থন টানতে পারবেন। একমাত্র ইরানি বিপ্লবই বিংশ শতাব্দীর কোনও আদর্শবাদ অনুপ্রাণিত বিপ্লব (রাশিয়া ও চীনা বিপ্লব উভয়েই কাল মার্কস-এর ঊনবিংশ শতাব্দীর আদর্শবাদে অনুপ্রাণিত ছিল)। খোমিনি শিয়া মতবাদের একেবারে ভিন্নতর ব্যাখ্যা খাড়া করেছিলেন: গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে একমাত্র অতীন্দ্রিয়ভাবে অনুপ্রাণিত জুরিস্টই- যিনি পবিত্র আইন জানেন- বৈধভাবে জাতিকে পরিচালিত করতে পারেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী দ্বাদশবাদী শিয়ারা ধর্মীয় পুরহিতদের সরকারে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু বিপ্লবীরা (উলেমাদের বেশীসংখ্যক যদি নাও হয়) এই বেলায়েত-ই ফাকিহ্’র (জুরিস্ট-এর ম্যান্ডেট)’ তত্ত্ব গ্রহণে আগ্রহী ছিল। বিপ্লবের পুরো সময়টায় কারবালার প্রতীক ছিল প্রভাবশালী। মৃতের জন্যে প্রচলিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি এবং হুসেইনের সম্মানে আশুরার উৎসব শাসকদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রূপ নেয়। কাররালার মিথ সাধারণ শিয়াদের শাহ্-র অস্ত্রকে অগ্রাহ্য করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এবং তারা শয়ে শয়ে প্রাণ দিয়েছে, কেউ কেউ শহীদের শাদা পোশাকে আবৃত ছিল। ধর্ম এমন এক শক্তিশালী শক্তি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে যা পাহলভী রাজ্যের পতন ঘটিয়েছে, যাকে কিনা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী বলে মনে হয়েছিল।
কিন্তু সকল মৌলবাদীর মত খোমিনির দর্শনও ছিল বিকৃতিপ্রবণ। তেহরানে আমেরিকানদের জিম্মি হিসাবে আটক (এবং পরে ইরানি উদাহরণে অনুপ্রাণিত লেবাননের শিয়া চরমপন্থীদের হাতে আমেরিকানদের বন্দীত্ব) বন্দীদের প্রতি আচরণের কুরান নির্দেশিত নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন: বন্দীদের সঙ্গে অবশ্যই মর্যাদা ও সম্মানসূচক আচরণ করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তি দিতে হবে। আক্রমণকারী পক্ষটি নিজের হাত থেকেই মুক্তিপণের টাকা দিতেও বাধ্য থাকবে। প্রকৃতপক্ষে কুরান রীতিসিদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া অন্য সময়ে কাউকে আটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা নিশ্চিতভাবে বৈরী অবস্থার অনুপস্থিতিতে কাউকে জিম্মি করা অনুমোদন করে না।` বিপ্লবের পর খোমিনি তাঁর ভাষায় “অভিব্যক্তির ঐক্যে”র ওপর জোর দিয়ে সবরকম ভিন্নমত দমন করেন। বাকস্বাধীনতার প্রতি উদ্বেগ বিপ্লবের অন্যতম দাবীই কেবল ছিল না, কিন্তু ইসলাম কখনও আদর্শগত সমরূপতার ওপর জোর দেয়নি, জোর দিয়েছে কেবল চর্চার সমরূপতার ওপর। ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি কুরানে নিষিদ্ধ এবং খোমিনির আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা– শিক্ষক মোল্লা সদরাও একে ঘৃণা করতেন। ফেব্রুয়ারি ১৪, ১৯৮৯তে খোমিনি যখন দ্য স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসে মুহাম্মদের (স:) ব্লাসফেমাস বিবরণ তুলে ধরার অভিযোগে ঔপন্যাসিক সালমান রুশদির বিরুদ্ধে ফাতওয়াহ্ জারি করেন তখনও তিনি চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে সদরার আন্তরিক অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন। আল-আয্হার এবং সৌদী আরবের এবং সৌদী আরবের উলেমাগণ ফাতওয়াকে অনৈসলামীক ঘোষণা করেন এবং এর পরের মাসে ইসলামী কনফারেন্সে ঊনচল্লিশটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে আটচল্লিশটি দেশ কর্তৃক নিন্দিত হয় ৷