অবশ্য যারা ধর্ম সম্পর্কে নানা মতের সৃষ্টি করেছে ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন কাজের দায়িত্ব তোমার নয়… বলো, “নিশ্চয় আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথে, সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মে- একনিষ্ঠ ইব্রাহিমের সমাজে, আর সে তো অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।” বলো, “আমার নামাজ, আমার উপাসনা, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহ্ই উদ্দেশ্যে।”[১৭]
কিবলার পরিবর্তন আরব মুসলিমদের, বিশেষ করে অভিবাসী, যারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরা করেছিল, তাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করে। মুসলিমরা আর অসহায়ের মত ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের পেছনে ঘুরবে না, যারা তাদের আকাঙ্ক্ষাকে বিদ্রূপ করে; বরং ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার জন্যে নিজস্ব পথ বেছে নেবে।
দ্বিতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে কিবলাহ্ পরিবর্তনের অল্প কিছুদিন পরেই। মুহাম্মদ(স:) এবং মক্কা থেকে আগত অভিবাসীদের মদীনায় জীবিকা নির্বাহের কোনও উপায় ছিল না; কৃষিকাজ করার মত পর্যাপ্ত জমি ছিল না তাদের জন্য; তাছাড়া তারা ছিল বণিক ও ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী নয়। আনসার (সাহায্যকারী ) হিসাবে পরিচিত মদিনাবাসীদের পক্ষে তাদের বিনে পয়সায় বহন করে চলা সম্ভব ছিল না, ফলে অভিবাসীরা ঘায়ু বা হানা’র আশ্রয় গ্রহণ করে, যা ছিল আরবের জাতীয় ক্রীড়ার মত, আবার একই সঙ্গে সেটা ছিল অপর্যাপ্ত সম্পদের দেশে সম্পদ পুনঃবণ্টনের কর্কশ এবং প্রচলিত উপায়। হানা পরিচালনাকারী দল প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও গোত্রের ক্যারাভান বা দলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে মালামাল ও গবাদি পশু ছিনিয়ে নিত, তবে খেয়াল রাখত যেন কেউ প্রাণ না হারায়, কেননা সেক্ষেত্রে প্রতিশোধ উৎসাহিত হতে পারে। মিত্র বা “ক্লায়েন্ট”-এ (অধিকতর শক্তিশালী গোত্রগুলোর নিরাপত্তাকাঙ্ক্ষী দুর্বলতর গোত্র) পরিণত গোত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা নিষিদ্ধ ছিল। কুরাইশদের হাতে নির্যাতিত এবং দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া অভিবাসীরা ধনী মক্কান ক্যারাভান সমূহের ওপর ঘায়ু পরিচালনা শুরু করে, যার ফলে অর্থের সমাগম ঘটে তাদের, কিন্তু আপন গোত্রের বিরুদ্ধে ঘায়ু পরিচালনা ছিল অতীতের মারাত্মক লঙ্ঘন। হানা পরিচালনাকারী দলগুলো কিছু প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছিল, কিন্তু মার্চ ৬২৪-এ মুহাম্মদ(স:) সেবছরের একটা বিরাট মক্কান ক্যারাভানকে কব্জা করার উদ্দেশ্যে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে উপকূলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই দুঃসহসের খবর পেয়ে কুরাইশরা ক্যারাভান রক্ষা করার জন্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায়ও বদর কূপের কাছে মুসলিমরা কুরাইশদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। যদিও মক্কাবাসীরা সংখ্যার দিক দিয়ে শক্তিশালী ছিল, তারা বেপরোয়া সাহসিকতা দেখিয়ে প্রাচীন আরবীয় কায়দায় যুদ্ধ করে প্রত্যেক সর্দার তার নিজস্ব দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। কিন্তু মুহাম্মদের(স:)-এর বাহিনীকে সযত্নে প্রস্তুত করা হয় এবং তারা তাঁর একক নির্দেশের অধীনে লড়াই করে। এই কায়দাটি বেদুইন গোত্রগুলোকে অভিভূত করে, তাদের কেউ কেউ শক্তিশালী কুরাইশদের নতি স্বীকারের দৃশ্য উপভোগও করেছে।
এরপর উম্মার জন্যে কঠিন সময় নেমে আসে। মদীনায় কিছু সংখ্যক পৌত্তলিকের সঙ্গে বৈরিতা মেনে নিয়ে চলতে হচ্ছিল মুহাম্মদ(স:)কে, এরা নবাগত মুসলিমদের ক্ষমতায় অসন্তুষ্ট ছিল এবং বসতি থেকে তাদের উৎখাতে বদ্ধপরিকর ছিল। মক্কার সঙ্গেও যুঝতে হচ্ছিল তাঁকে, আবু সুফিয়ান সেখান থেকে তখন যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন, তিনি মদীনায় বাসরত মুসলিমদের বিরুদ্ধে দুদুটো আক্রমণ শানিয়েছিলেন। উম্মাহকে কেবল যুদ্ধ পরাজিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সমগ্র মুসলিম গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছেন তিনি। মরুভূমির কঠিন নীতিমালা অনুযায়ী যুদ্ধে মাঝামাঝি বলে কোনও সমাধান ছিল নাঃ সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বিজয়ী গোত্র প্রধান শত্রুপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন বলেই ধরে নেয়া হয়; সুতরাং, উম্মাহ্ পুরোপুরি অস্তিত্ব হারানোর হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। ৬২৫-এ উঁহুদের যুদ্ধে মক্কা উম্মাহর উপর মারাত্মক পরাজয় চাপিয়ে দেয়, কিন্তু এর দুবছর পর মুসলিমরা মক্কাবাসীদের পরিখার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত। পরিখার যুদ্ধ নাম হবার কারণ মুহাম্মদ(স:) মদীনার চারপাশে পরিখা খনন করে বসতিকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কুরাইশরা তখনও যুদ্ধকে বরং বীরত্বব্যাঞ্জক খেলা হিসাবেই বিবেচনা করত, এধরনের অসমর্থনযোগ্য কৌশলের কথা তাদের কাছে অশ্রুতপূর্ব ছিল, ফলে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল তারা এবং তাদের অশ্বারোহী বাহিনী অকেজো হয়ে পড়ে। সংখ্যার দিক থেকে শক্তিশালী কুরাইশদের বিরুদ্ধে (মক্কাবাসীর সংখ্যা ছিল দশ হাজার আর মুসলিমরা ছিল তিন হাজার) মুহাম্মদের(স:) দ্বিতীয় বিজয় ছিল বাঁক পরিবর্তনকারী ঘটনা। যাযাবর গোত্রগুলোর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে মুহাম্মদ(স:)ই আগামীর নেতা, আর কুরাইশদের মনে হয়েছে বিগত যৌবন। তারা যেসব দেবতার নামে যুদ্ধ করছিল তারা আর তাদের পক্ষে কাজ করছিল না। বহু সংখ্যক গোত্রই উম্মাহর সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে, এবং মুহাম্মদ (স:) একটি গোত্রীয় শক্তিশালী কনফেডারেসি গড়ে তুলতে শুরু করেন, যার সদস্যরা পরস্পরের ওপর আক্রমণ না চালানো এবং পরস্পরের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছিল। মক্কাবাসীদেরও কেউ কেউ পক্ষ ত্যাগ করে মদীনায় হিজরা শুরু করে; অবশেষে পাঁচ বছরের ভয়ঙ্কর বিপদ-সঙ্কুল সময় পেরিয়ে মুহাম্মদ (স:) আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন যে উম্মাহ্ টিকে থাকবে।