প্রত্যেক সুন্নী মৌলবাদী আন্দোলনের ওপরই কুত্ত্বের প্রভাব রয়েছে। অত্যন্ত লক্ষ্যণীয়ভাবে এটা মুসলিমদের আপন জাতির প্রতি নির্যাতনমূলক নীতিমালা প্রয়োগের কারণে জাহিলি শাসক হিসাবে আনোয়ার আল-সাদাঁতের মত শাসকদের হত্যায় অনুপ্রাণিত করেছে। ১৯৯৪-তে আফগানিস্তানে ক্ষমতা লাভকারী তালিবানরাও তাঁর আদর্শে প্রভাবিত। তাদের দৃষ্টিতে তারা ইসলামের মৌলরূপে প্রত্যাবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। উলেমারা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন, নারীরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে আছে এবং পেশাগত জীবনে অংশ গ্রহণের অনুমোদন নেই তাদের। কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই প্রচারের অনুমোদন পাচ্ছে এবং পাথর ছোঁড়া ও অঙ্গচ্ছেদের মত ইসলামী শাস্তির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। পশ্চিমের কোনও কোনও বলয়ে তালিবানদের খাঁটি মুসলিম বলে মনে করা হয়, কিন্তু তাদের শাসনে অত্যাবশ্যকীয় ইসলামী নীতির লংঘন ঘটছে। তালিবানদের অধিকাংশ ( মাদ্রাসার “ছাত্র” এরা) পশতুন গোত্রের সদস্য এবং অ-পশতুনদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে চায় তারা-যারা দেশের উত্তরাংশ থেকে শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এরকম জাতিগত শভ্যেনিজম পয়গম্বর এবং কুরান কর্তৃক নিষিদ্ধ। সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর ওপর তাদের নিষ্ঠুর আচরণও কুরানের নির্দেশের স্পষ্ট পরিপন্থী। নারীদের প্রতি প্রদর্শিত তালিবানদের বৈষম্যও পয়গম্বরের আচরণ এবং প্রথম উম্মাহর অনুশীলনের সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশ্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের অতি বাছাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তালিবানরা বৈশিষ্ট্যগতভাবে মৌলবাদী, (যা পাকিস্তানের কোনও কোনও মাদ্রাসায় তাদের সংকীর্ণ শিক্ষার প্রতিফলন দেখায়), ধর্মকে যা বিকৃত করে এবং প্রত্যাশিত পথের বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যায়। সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের মত মুসলিম মৌলবাদীরা টিকে থাকার সংগ্রামে ধর্মকে নির্যাতন এমনকি সহিংসতার হাতিয়ারে পরিণত করে থাকে।
কিন্তু অধিকাংশ সুন্নী মৌলবাদীরা এধরনের চরম পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করেনি। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে জন্ম নেয়া মৌলবাদী আন্দোলনগুলোর সবক’টাই তাদের আশপাশের জগতকে অপেক্ষাকৃত কম ধ্বংসাত্মক অথচ কার্যকরভাবে বদলে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিল। ১৯৬৭তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের শোচনীয় পরাজয়বরণের পর গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা গেছে। আল-নাসেরের মত চরম সেক্যুলারিস্ট শাসকদের পুরনো সেক্যুলার নীতি অকার্যকর বলে মনে হয়েছে। জনগণ মনে করেছে যে ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত না হওয়ার কারণেই ব্যর্থ হয়েছে তারা। তারা লক্ষ্য করেছিল যে সেক্যুলারিজম এবং গণতন্ত্র পশ্চিমে চমৎকারভাবে কাজ করলেও সেগুলো সাধারণ মুসলিমদের কোনও উপকারে আসে না, বরং ইসলামী জগতের সংখ্যালঘু অভিজাত শ্রেণীই লাভবান হয়। মৌলবাদকে “উত্তর-আধুনিক” আন্দোলন হিসাবে দেখা যেতে পারে, যা ঔপনিবেশিকতাবাদের মত আধুনিকতার কোনও কোনও বৈশিষ্ট্য এবং উদ্দীপনাকে অস্বীকার করে। সমগ্র ইসলামীবিশ্ব জুড়ে ছাত্র এবং শ্রমিকরা তাদের প্রত্যক্ষ পরিপার্শ্ব পরিবর্তনের কাজ শুরু করে। তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারখানাগুলোয় মসজিদ নির্মাণ করেছে যাতে সেখানে সালাত আদায় করতে পারে এবং বান্না-কায়দায় ইসলামী পরিচয় সমৃদ্ধ কল্যাণমূলক সোসায়েটি গঠন করেছে। সেক্যুলারিস্ট সরকারের চেয়ে জনগণের কল্যাণে ইসলামই যে অগ্রসর সেটা প্রদর্শন করেছে। ছাত্ররা যখন কোনও উঠানের ছায়াঢাকা অংশকে- কিংবা কোনও নোটিসবোর্ডকেও- একটা ইসলামী এলাকা হিসাবে ঘোষণা দেয় তখন তারা ধরে নেয় যে সেক্যুলারিস্ট সমাজে উপেক্ষিত এবং অবনমিত ইসলামকে প্রান্তিক পর্যায় থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ক্ষুদ্র হলেও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া গেছে এবং বিশ্বের একটা অংশকে- যত ক্ষুদ্রই হোক- ইসলামের অংশে পরিণত করা গেছে। তারা ইসরায়েলে ইহুদি মৌলবাদী, যারা অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন করার মাধ্যমে আরবভূমি দখল করে নিয়ে একে জুডাইজমের অন্তর্ভুক্ত করছে ঠিক তাদের মত করেই পবিত্রতার সীমানা সামনে ঠেলে দিচ্ছে।
ইসলামী পোশাকে প্রত্যাবর্তনের পেছনেও একই নীতিমালা কাজ করছে। এটা যখন জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া হয় (তালিবানরা যেমন করেছে) তখন নির্যাতনমূলক হয়ে দাঁড়ায় এবং রেযা শাহ্ পাহলভীর আক্রমণাত্মক কৌশলগুলোর মত তীব্র পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বহু মুসলিম নারী মনে করে অবগুণ্ঠন হচ্ছে প্রাক-উপনিবেশ আমলে প্রতীকী প্রত্যাবর্তন- যখন তাদের সমাজ প্রকৃত গতিপথ থেকে বিচ্যুত এবং বিচ্ছিন্ন হয়নি। কিন্তু তারা স্রেফ ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেয়নি। জরিপে দেখা গেছে পর্দাধারী নারীদের বিপুল অংশ লিঙ্গ প্রসঙ্গের মত বিষয়ে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। কোনও কোনও মহিলার ক্ষেত্রে–যারা গ্রামাঞ্চল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে এবং পরিবারের তারাই মৌলিক সাক্ষরতা অর্জনের গণ্ডি পেরুনো প্রথম সদস্য- ইসলামী পোশাক ধারণ ধারাবাহিকতার অনুভূতি যোগায় এবং আধুনিকতায় উত্তোরণকে অনেক কম যন্ত্রণাময় করে, যা অন্যভাবে কঠিন হত। তারা আধুনিক বিশ্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তবে সেটা তাদের নিজস্ব কায়দায় এবং ইসলামী প্রেক্ষিতে যা একে পবিত্র অর্থ দেয়। অবগুণ্ঠনকে আধুনিকতার কম ইতিবাচক দিকগুলোর তীব্র সমালোচনা হিসাবেও দেখা যেতে পারে। এটা যৌনতার বিষয়ে পাশ্চাত্যের “সব প্রকাশ করে দেয়া”র অদ্ভুত বাধ্যবাধকতাকে অগ্রাহ্য করে। পশ্চিমে মানুষ প্রায়ই তাদের তামাটে সুগঠিত দেহ বিশেষ অধিকারের প্রতীক হিসাবে প্রদর্শন করে থাকে, তারা বয়সের লক্ষণের উল্টোধারায় চলায় প্রয়াস পায় এবং এই জীবন আঁকড়ে থাকতে চায়। অবগুণ্ঠিত ইসলামী দেহ দেখায় যে তা দুর্ভেয়মুখী; পোশাকের সমরূপতা শ্রেণী বৈষম্য দূর করে এবং পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের বিপরীতে গোষ্ঠী বা সমাজের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।