মুসলিম মৌলবাদ এইসব সাধারণ বৈশিষ্টাবলীর সঙ্গে মিলে যায়। সুতরাং এটা কল্পনা করে নেয়া ঠিক হবে না যে ইসলামের অভ্যন্তরেই এক জঙ্গী ধর্মান্ধতার উপাদান রয়েছে মুসলিমদের যা আধুনিকতাকে প্রবল এবং সহিংসভাবে প্রত্যাখ্যানে প্ররোচিত করে। বিশ্বের অন্য সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদীদের সঙ্গে মুসলিমদেরও মিল আছে, যারা আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতির প্রতি তাদের গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে। একথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুসলিমরা যে, মুসলিমরা মৌলবাদ (Fundamentalism) শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সঠিক যুক্তিতেই আপত্তি উত্থাপন করে থাকে যে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা গর্বের প্রতীক হিসাবে এর উৎপত্তি ঘটিয়েছিল এবং সাধারণভাবে এ শব্দের আরবী অনুবাদ করা যায় না। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, উসুল ইসলামী জুরেসপ্রুডেন্সের মৌলনীতিমালার কথা বলে এবং সকল মুসলিম এ ব্যাপারে একমত, সকল মুসলিমই উসুলিয়াহ্’য় (মৌলবাদ) বিশ্বাসী বলে মত দেয়া যেতে পারে। তা সত্ত্বেও, “মৌলবাদ”-এর সকল দুর্বলতা ছাপিয়ে এই শব্দটি প্রয়োগ করেই কেবল আমরা রণসজ্জিত ধর্মীয় আন্দোলনের সদস্যটির বর্ণনা দিতে পারি। এর চেয়ে সন্তোষজনক কোনও বিকল্প শব্দ উদ্ভাবন বেশ কঠিনই বটে।
মৌলবাদী আদর্শবাদীদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন পাকিস্তানে জামাত-ই ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওদুদি। তিনি দেখেছেন পাশ্চাত্যের প্রবল শক্তি ইসলাম ধ্বংসের লক্ষ্যে শক্তি সঞ্চয় করছে। মুসলিমদের উচিত, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, এই আধিপত্যবাদী সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে অবশ্য অবশ্য ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা, যদি তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মুসলিমরা আগেও বৈরী সমাজের মোকাবিলা করেছে, ধ্বংসলীলা দেখেছে, কিন্তু আফগানির পর থেকে ইসলামী আলোচনায় (discourse) একটা নতুন সুর ঢুকে পড়েছিল। পাশ্চাত্যের হুমকি প্রথমবারের মত মুসলিমদের আত্মরক্ষার পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিল। মাওদুদি সব সেক্যুলারিস্ট নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করেছেন: একটা ইসলামী মুক্তির থিওলজির প্রস্তাবনা রাখছিলেন তিনি। একমাত্র ঈশ্বরই যেহেতু সার্বভৌম, সুতরাং মানুষের কাছ থেকে নির্দেশ নিতে কেউই বাধ্য নয়। ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল অধিকার বা ন্যায়সঙ্গত নয়, বরং তা অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। মাওদুদি এক বিশ্বজনীন জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঠিক পয়গম্বর যেমন করে জাহিলিয়ার (প্রাক-ইসলামী কালের “অজ্ঞতা” ও বর্বরতা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, মুসলিমদেরও ঠিক সেভাবে পাশ্চাত্যের আধুনিক জাহিলিয়াহ্ অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। মাওদুদি উল্লেখ করেছেন যে, জিহাদই ইসলামের মূলকথা (tenet)। এক নতুন উদ্ভাবন ছিল এটা। এর আগে কেউ কখনও দাবী করেনি যে জিহাদ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের সমতূল্য, কিন্তু মাওদুদি মনে করেছেন যে বর্তমান জরুরি অবস্থায় এই উদ্ভাবন যুক্তিসঙ্গত। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অস্তিত্বহীনতার চাপ ও আতঙ্ক ধর্মকে অধিকতর চরম এবং সহিংস বিকৃতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু সুন্নী বিশ্বে ইসলামী মৌলবাদের প্রকৃত জন্মদাতা হলেন সায়ীদ কুত্ব (১৯০৬-৬৬), তাঁর ওপর মাওদুদির সীমাহীন প্রভাব ছিল। কিন্তু আদিতে চরমপন্থী ছিলেন না তিনি বরং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং সেক্যুলার রাজনীতির প্রতি তীব্র অনুরাগ ছিল তাঁর। এমনকি ১৯৫৩তে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেয়ার পরেও একজন সংস্কারকই রয়ে গিয়েছিলেন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে ইসলামী রূপ দেয়ার আশা করেছিলেন যাতে পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলারিস্ট আদর্শবাদের বাড়তি উপাদানগুলো এড়ানো যায়। কিন্তু ব্রাদারহুডের সদস্য হওয়ার কারণে ১৯৫৬তে আল-নাসের কর্তৃক কারারুদ্ধ হন তিনি; এরপর নির্যাতন শিবিরে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে যান যে ধার্মিক ব্যক্তি আর সেক্যুলারিস্টদের পক্ষে একই সমাজে বসবাস সম্ভব নয়। ব্রাদার্স-এর সদস্যদের ওপর চালানো নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড এবং মিশরে ধর্মকে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেয়ার আল-নাসেরের অঙ্গীকার প্রত্যক্ষ করার সময় তিনি জাহিলিয়া সকল বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্য করেছেন, যাকে তিনি ধর্ম বিশ্বাসের চিরন্তন প্রতিপক্ষ বর্বরতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন; এজন্যে পয়গম্বর মুহাম্মদের(স:) অনুসরণে মুসলিমদের আমৃত্যু যুদ্ধ করা আবশ্যক। কুত্ব মাওদুদি থেকে আরও অগ্রসর হয়েছেন, কেবল অমুসলিম সমাজকেই জাহিলি হিসাবে দেখেছিলেন তিনি (মাওদুদি)। কুত্ব আরবের প্রাক- ইসলামী পর্যায়কে বর্ণনা করার জন্যে প্রচলিত মুসলিম ইতিহাস শাস্ত্রে ব্যবহৃত জাহিলিয়াহ্ শব্দকে সমসাময়িক মুসলিম সমাজে প্রয়োগ করেছেন। যদিও আল- নাসেরের মত একজন শাসক উপরে উপরে ইসলামের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর কথা এবং কাজে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি একজন ধর্মত্যাগী, এবং মুহাম্মদ(স:) যেভাবে মক্কার পৌত্তলিক প্রশাসনকে (তাঁর আমলের জাহিলিয়াহ্) পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য করেছিলেন ঠিক সেভাবে এধরনের সরকারকে উচ্ছেদ করা মুসলিমদের অবশ্য কর্তব্য।
আল-নাসেরের সহিংস সেক্যুলারিজম কুত্বকে এমন এক ইসলাম প্রবর্তনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল যা কুরানের বাণী এবং পয়গম্বরের জীবন, উভয়কেই বিকৃত করেছে। কুত্ব মুসলিমদের মুহাম্মদের(স:) আদর্শে নিজেদের গড়ে তুলতে বলেছেন, নিজেদের সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়ার জন্যে বলেছেন { যেমন মুহাম্মদ(সঃ) করেছিলেন মক্কা থেকে মদীনায় হিজরার মাধ্যমে } এবং তারপর প্রবল জিহাদে যোগ দিতে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ(স:) এক অনন্যসাধারণ অহিংস নীতি অনুসরণ করে বিজয় অর্জন করেছিলেন; ধর্মীয় ব্যাপারে বল প্রয়োগ এবং নিপীড়নের ঘোরতর বিরোধী কুরান এবং এর দর্শন- বিচ্ছিন্নতা ও বর্জনের শিক্ষা থেকে বহুদূরে- সহিষ্ণু ও গ্রহণের। কুত্ব জোর দিয়ে বলেছেন যে কেবল ইসলামের রাজনৈতিক বিজয় এবং প্রকৃত মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই কুরান জারিকৃত সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি আসতে পরে। মৌলবাদী ধর্মের অন্তস্তলে বিরাজিত গভীর আতঙ্কে থেকেই নয়া নিরাপোস মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। কুত্ব রক্ষা পাননি। আল-নাসেরের ব্যক্তিগত জেদেই ১৯৬৬-তে তাঁর প্রাণ সংহার করা হয়।