সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদী আন্দোলনের কতগুলো সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলো প্রতিশ্রুতিসমূহ রক্ষায় ব্যর্থ আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি গভীর নৈরাশ্য আর মোহমুক্তির প্রকাশ ঘটায়। এগুলো প্রকৃত আতঙ্কও তুলে ধরে। আমার পর্যালোচিত প্রতিটি মৌলবাদী আন্দোলন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সেক্যুলার প্রশাসন ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ। সবসময় এটা অমূলক প্রতিক্রিয়া নয়। আমরা দেখেছি যে মুসলিম বিশ্বে খুবই আক্রমণাত্মকভাবে সেক্যুলারিজম আরোপ করা হয়েছে। মৌলবাদীরা অনুপ্রেরণা পাবার জন্যে আধুনিকতার হামলা- পূর্ব কালীন এক “স্বর্ণযুগে”র শরণাপন্ন হয়ে থাকে, কিন্তু তারা পূর্বানুবৃত্তিমূলকভাবে (atavistically) মধ্যযুগে প্রত্যাবর্তন করে না। সবগুলোই সহজাতভাবেই আধুনিক আন্দোলন এবং আমাদের কাল ছাড়া অন্য কোনও যুগে আবির্ভূত হবার উপায় নেই তাদের। সবগুলোই উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন এবং ধর্মের পুন:ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রায়ই চরমপন্থী। সুতরাং মৌলবাদ আধুনিক প্রেক্ষাপটের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আধুনিকতা যখনই শেকড় ছড়ায়, একটা না একটা মৌলবাদী আন্দোলন তার সচেতন প্রতিক্রিয়া হিসাবেই পাশাপাশি উত্থিত হতে পারে। মৌলবাদীরা প্রায়ই তাদের ঐতিহ্যের সেইসব উপাদানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক কোনও পরিবর্তনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে যেগুলো এর সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। এরা সবাই-এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও-গণতন্ত্র এবং সেক্যুলারিজমের তীব্র সমালোচক। নারী-মুক্তি যেহেতু আধুনিক সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, মৌলবাদীরা প্রচলিত কৃষিভিত্তিক লিঙ্গ-ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে নারীদের অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঘরে আটকে রাখতে চায়। মৌলবাদী গোষ্ঠীকে এভাবে আধুনিকতার ছায়া হিসাবে দেখা যেতে পারে; আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকও তুলে ধরতে পারে এটা।
সুতরাং মৌলবাদ এক প্রতীকী সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নিপীড়ক সেক্যুলাজিমের সঙ্গে সহাবস্থান করে। মৌলবাদীরা সব সময়ই উদারনৈতিক বা আধুনিকীকরণ প্রশাসনের দ্বারা আক্রান্ত বোধ করে এবং পরিণামে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর আচরণ আরও চরম হয়ে ওঠে। টেনেসির বিখ্যাত স্কোপস ট্রায়ালের (১৯২৫) পর যখন প্রটোস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা সরকারী স্কুলগুলোয় বিবর্তনবাদ শিক্ষা দেয়া বন্ধ করার প্রয়াস পেয়েছিল, সেক্যুলারিস্ট পত্রিকাগুলো তখন এমনভাবে তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ শুরু করে যে তাদের থিওলজি আরও প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রবলভাবে আক্ষরিক হয়ে ওঠে এবং তারা রাজনৈতিক বলয়ের চরম বামপন্থী থেকে চরম ডানপন্থী দিকে সরে যায়। সেক্যুলারিস্ট আক্রমণ যখন অধিকতর সহিংস হয়ে উঠেছে, মৌলবাদী প্রতিক্রিয়ারও আরও তীব্র হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। মৌলবাদীরা, সুতরাং, সমাজের একটা ফাটল প্রকাশ করে, সেক্যুলার সংস্কৃতি উপভোগকারী এবং একে আতঙ্কের সঙ্গে বিবেচনাকারীদের মাঝখানে যা দেখা দেয়। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই শিবির ক্রমবর্ধমান হারে পরস্পরকে বুঝে উঠতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এভাবে মৌলবাদ অভ্যন্তরীণ বিরোধ হিসাবে সূচিত হয়- কারও নিজস্ব সংস্কৃতি বা জাতির মধ্যকার উদারপন্থী বা সেক্যুলারিস্টদের সঙ্গে। প্রথমটির উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম মৌলবাদীরা প্রায়শ পাশ্চাত্য বা ইসরায়েলের মত বহিঃশত্রুর বিরোধিতার চেয়ে স্বদেশবাসী বা সতীর্থ মুসলিমদের আধুনিকতা সম্পর্কে অধিকতর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের বিরোধিতা করবে। খাঁটি ধর্মবিশ্বাসের একটা ছিটমহল সৃষ্টির লক্ষ্যে মৌলবাদীরা প্রায়ই প্রথমে সংস্কৃতির মূলধারা হতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় (যেমন, উদাহরণস্বরূপ, জেরুজালেম বা নিউ ইয়র্কে আল্ট্রা-অর্থোডক্স ইহুদি জনগোষ্ঠীর ভেতর)। এরপর তারা কখনও কখনও মূলধারাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এনে পুনঃপবিত্রকরণের লক্ষ্যে এমন এক আক্রমণ পরিচালনার প্রয়াস পায় যার রূপ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। মৌলবাদীদের সবার বিশ্বাস তারা অস্তিত্ব রক্ষার জন্যেই লড়ছে। এবং তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে তারা মনে করতে পারে যে অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে লড়াই ছাড়া গত্যন্তর নেই তাদের। মানসিকতার এমন একটা পর্যায়ে, বিরল ক্ষেত্রে, কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের আশ্রয় গ্রহণ করে। অবশ্য সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় না, কিন্তু তারা অধিকতর প্রচলিত বৈধ উপায়ে ধর্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণের প্রয়াস পায় মাত্র।
ধর্মকে সাইডলাইন থেকে আবার মধ্যমঞ্চে ঠেলে আনার ব্যাপারে সফল হয়েছে মৌলবাদ, যার ফলে এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রধান ভূমিকা পালন করছে এটা। এমন একটা অবস্থা বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ছিল অচিন্ত্যনীয়, যখন সেক্যুলারিজমকে অপ্রতিরোধ্য ঠেকেছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকে ইসলামী বিশ্বে নিঃসন্দেহে এটাই ঘটেছে। কিন্তু মৌলবাদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনে ধর্মকে “ব্যবহার” করার সামান্য উপায়মাত্র উপায়মাত্র নয়।
এগুলো অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সেক্যুলারিস্টদের দ্বারা মানুষের জীবন থেকে ঈশ্বরের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আধুনিক বিশ্বে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধসমূহের প্রাধান্য বিস্তারের পৌনঃপুনিক মরিয়া প্রয়াস। কিন্তু মৌলবাদকে উস্কে দেয়া হতাশা আর আতঙ্ক ধর্মীয় ট্র্যাডিশনকেও বিকৃত করতে চায় এবং সহিষ্ণুতা এবং সমন্বয়ের পক্ষাবলম্বনকারীদের বাদ দিয়ে অধিকতর আক্রমণাত্মক দিকগুলোকে উচ্চকিত করে তোলে।