১৯৭০-র দশকে ইসলামপন্থী শক্তিগুলো সরকারের প্রধান বিরোধী পক্ষে পরিণত হয় এবং বামপন্থী সেক্যুলারিস্ট প্রধানমন্ত্রী জুলফাঁকির আলী ভূট্টো (১৯৭১- ৭৭) অ্যালকোহল ও জুয়া নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদের শান্ত করার প্রয়াস পান। কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭৭-এর জুলাইয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মুহাম্মদ যিয়া আল-হক এক সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন এবং অধিকতর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পোশাক পুনর্বহাল করেন, ইসলামী ফোজদারি ও বাণিজ্যিক আইন ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যিয়াও এমনকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, যেখানে তাঁর নীতিমালা স্পষ্টতই সেক্যুলারিস্ট ছিল। ১৯৮৮-তে এক বিমান দুর্ঘটনার তাঁর মৃত্যুর পর থেকে পাকিস্তানি রাজনীতিতে জাতিগত বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে বৈরিতা আর দুর্নীতি দেখা দেয় এবং প্রভাব হারায় ইসলামপন্থীরা। পাকিস্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে, জনজীবনেও এর উপস্থিতি ব্যাপক; কিন্তু তারপরেও মূল রাজনীতিকে তা প্রভাবিত করতে পারছে না। আপোসের ব্যাপারটি আব্বাসীয় ও মঙ্গোলদের সমাধানেরই স্মারক, যারা ক্ষমতার অনুরূপ বিচ্ছিন্নতা প্রত্যক্ষ করেছিল। রাষ্ট্র যেন ইসলামী শক্তিগুলোকে পথে আনতে বাধ্য করেছে, কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম আদর্শের চেয়ে বহুদূর। ভারতের মত পারমাণবিক অস্ত্রখাতে বেহিসাবী অর্থ ব্যায়িত হচ্ছে যেখানে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ সীমাহীন দারিদ্র্যতায় শেষ হয়ে যাচ্ছে– এই পরিস্থিতি প্রকৃত মুসলিম অনুভূতির কাছে ঘৃণ্য। রাষ্ট্র কর্তৃক নির্যাতিত বোধকারী মুসলিমরা প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মৌলবাদী তালিবান সরকারের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
মুসলিমরা এখনও বিংশ শতাব্দীর উপযোগী আদর্শ রাজনীতির সন্ধান পায়নি বলে ইসলাম আধুনিকতার সঙ্গে মানানসই বলা যাবে না। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ইসলামী আদর্শকে স্থাপন করা এবং সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান মুসলিমদের গোটা ইতিহাস জুড়ে আলোড়িত করে এসেছে। কারণ যেকোনও ধর্মীয় মূল্যবোধের মত প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা দুয়ে, একে কখনও মানবীয় ভাষায় সঠিকভাবে প্রকাশ করা যাবে না এবং তা সবসময় মানুষের নাজুক ও ত্রুটিময় উপলব্ধির অতীত হয়ে যাবে। ধর্মীয় জীবন কঠিন, আধুনিক সংস্কৃতির সেক্যুলার যুক্তিবাদ অন্য সকল প্রধান ট্র্যাডিশনের মানুষের জন্যে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। রাজনীতির চেয়ে মতবাদসমূহের প্রতি অধিক মনোযোগী ক্রিশ্চানরাও আজকাল আধুনিক ভাবধারায় তাদের ধর্মবিশ্বাসকে বাঙ্ময় করে তোলার জন্যে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে। যেমন উদাহরণস্বরূপ, তারা ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে, কেউ কেউ ধর্মের পুরনো নিয়মাচার আঁকড়ে ধরছে, অন্যরা আরও রেডিক্যাল সমাধান খুঁজে নিচ্ছে। কখনও কখনও এইসব আলোচনা যন্ত্রণাদায়ক এমনকি তিক্ততার জন্ম দেয়, কেননা এসব ইস্যু খ্রিস্টীয় দর্শনের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ধার্মিকতার মর্মমূল স্পর্শ করে। আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে সংগ্রাম এই দোদুল্যমানতার মুসলিম সমরূপ। সকল ধার্মিক জাতিকে যেকোনও যুগে সেই সময়ের বিশেষ আধুনিকতার প্রতি সাড়া দেয়ার জন্যে তাদের ট্রাডিশনকে প্রস্তুত করতে হয়। একটি আদর্শ মুসলিম সরকারের অনুসন্ধানকে পথবিচ্যুতি হিসাবে দেখা উচিত হবে না বরং একে অত্যাবশ্যকীয় এবং যথার্থ ধর্মীয় কার্যক্রম বলেই ধরে নিতে হবে।
মৌলবাদ
পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায়শ “মৌলবাদ” হিসাবে পরিচিত যুদ্ধংদেহী এবং কখনও কখনও সহিংস ধার্মিকতাকে একেবারেই ইসলামী ব্যাপার বলে ধারণা দিয়ে থাকে। আসল ব্যাপার তা নয়। মৌলবাদ এক বিশ্বজনীন ব্যাপার এবং আমাদের আধুনিকতার সমস্যাদির প্রতি সাড়া হিসাবে সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেই আবির্ভূত হয়েছে। মৌলবাদী জুডাইজম যেমন আছে, মৌলবাদী ক্রিশ্চানিটিও আছে, মৌলবাদী হিন্দুধর্মমত, মৌলবাদী বুদ্ধধর্ম, মৌলবাদী শিখধর্ম এবং এমনকি মৌলবাদী কনফুসিয়বাদ পর্যন্ত আছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিশ্চান জগতে প্রথম এধরনের ধর্মবিশ্বাস আবির্ভূত হয়েছিল। এটা কোনও ঘটনাচক্রের সংঘটন ছিল না। মৌলবাদ কোনও মনোলিথিক আন্দোলন নয়, মৌলবাদের প্রত্যেকটা রূপ (form), এমনকি একই ট্র্যাডিশনে হলেও, স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়, এর নিজস্ব প্রতীক ও উদ্দীপনা থাকে, কিন্তু এর ভিন্নতর প্রকাশগুলো এক পারিবারিক সাদৃশ্যতা বহন করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে পশ্চিমা আধুনিকতার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে চকিত প্রতিক্রিয়া হিসাবে কোনও মৌলবাদী আন্দোলন সূচিত হয় না, বরং আধুনিকতার ধারা বেশ খানিকটা অগ্রসর হওয়ার পরই কেবল একটা রূপ নিতে শুরু করে। শুরুতে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের ট্র্যাডিশনসমূহে সংস্কারের প্রয়াস পায়; আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে সেগুলোর সমন্বয় সাধন করতে চায়; যেমন মুসলিম সংস্কারবাদীদের করতে দেখেছি আমরা। কিন্তু যখন দেখা যায় যে এসব মধ্যপন্থী ব্যবস্থাগুলো ব্যর্থ হয়েছে, কেউ কেউ আরও চরম পন্থার আশ্রয় নেয় এবং এক মৌলবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। পেছনে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই যে আধুনিকতার শো-কেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই মৌলবাদ নিজের অস্তিত্ব প্রথম তুলে ধরবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল; এবং পরবর্তী সময়ে তা বিশ্বের অন্যান্য স্থানে দেখা দিয়েছে। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের ভেতর প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই সবার শেষে মৌলবাদী ছোপ পড়েছে- ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে যখন মুসলিম বিশ্বে আধুনিক সংস্কৃতি শেকড় ছড়াতে শুরু করেছিল। এই সময়ের মধ্যে ক্রিশ্চান ও ইহুদিদের ভেতর মৌলবাদ বেশ ভালোভাবেই জাঁকিয়ে বসেছিল, যাদের আধুনিকতার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ছিল দীর্ঘ সংস্রব।