গণতন্ত্রও সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। সংস্কারকদের মাঝে যাঁরা ইসলামী কাঠামোতে আধুনিকতাকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা তুলে ধরেছেন যে গণতন্ত্রের আদর্শ খোদ ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন নয়। ইসলামী আইন শুরাহ্ (পরামর্শ) এবং ইজমাকে উৎসাহিত করে, যেখানে আইন-কানুনকে অবশ্যই উম্মাহ্ জনপ্রতিনিধিশীল অংশের “ঐকমত্য” দ্বারা অনুমোদিত হতে হয়। রাশিদুনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসবই গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে মানানসই। সমস্যার অংশ বিশেষ নিহিত রয়েছে পাশ্চাত্য প্রণীত গণতন্ত্রে যেখানে “সরকার জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যে”। ইসলামে জনগণ নয়, ঈশ্বর কোনও সরকারের বৈধতা দান করেন। মানুষের উন্নীত অবস্থান বহুঈশ্বরবাদ (শিরক) বলে মনে হতে পারে যেহেতু তা ঈশ্বরের সার্ভভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। কিন্তু পাশ্চাত্য স্লোগানের অনুসরণ না করেও মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়নি। তবে গণতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবক্ষেত্রে প্রায়শ অপব্যবহৃত হয়েছে। ১৯০৬-এ ইরানি জনগণ সাংবিধানেক বিপ্লবের পর মজলিস (সংসদ) গঠন করে, রাশানরা তা রদ করার বেলায় শাহকে সহযোগিতা দিয়েছিল। পরে, ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশরা যখন ইরানকে প্রটেক্টরেটে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পায়, আমেরিকানরা লক্ষ্য করে যে তারা প্রায়ই নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে ফলাফল টানার জন্যে কারচুপির আশ্রয় নিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে রেযা শাহ্ যখন তাঁর আধুনিকীকরণ কর্মসূচি কার্যকর করার জন্যে কেবল মজলিসই রদ করেননি, বরং ইরানের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তখন তাঁর প্রতি আমেরিকার সমর্থন এই ধারণা দিয়েছে যে গণতন্ত্রের মানবাধিকার নিশ্চিত করার বেলায় ডাবল স্ট্যান্ডার্ড অনুসৃত হচ্ছে। পাশ্চাত্য এর জনগণের জন্যে সগর্বে গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু মুসলিমরা নিষ্ঠুর স্বৈরাচারদের কাছে মাথা নত করবে, এটাই আশা করা হয়েছে যেন। মিশরে ১৯২৩ থেকে ১৯৫২ সময়কালের মধ্যে সতেরটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, প্রতিবারই জনপ্রিয় ওয়াফদ্ পার্টি জয় পেয়েছে, কিন্তু ওয়াফদ্ মাত্র পাঁচবার শাসন করার অনুমতি পেয়েছিল। ব্রিটিশ কিংবা মিশরের রাজা তাদের ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করেছিল।
সুতরাং ধর্মকে ব্যক্তিপর্যায়ে ঠেলে দেবে এমন গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গঠন মুসলিমদের জন্যে কঠিন। অন্য সমাধানগুলোকে খুব সুবিধাজনক মনে হয়নি। ১৯৩২-এ প্রতিষ্ঠিত কিংডম অভ সৌদি আরাবিয়া ওয়াহহাবি আদর্শে বিশ্বাসী। সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংবিধান অপ্রয়োজনীয়, কেননা সরকারের ভিত্তি হচ্ছে কুরানের আক্ষরিক পাঠ। কিন্তু কুরানে আইনের পরিমাণ খুবই কম এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এর পরিপূরক হিসাবে সব সময়ই জটিল জুরেসপ্রুডেন্স প্রয়োজন বলে দেখা গেছে। সৌদীরা দাবী করে যে তারা আরবীয় পেনিনসূলার আদি ইসলামের উত্তরাধিকারী এবং উলেমাগণও রাষ্ট্রের বৈধতা মেনে নিয়েছেন; বিনিময়ে রাজাগণ রক্ষণশীল ধর্মীয় মূল্যবোধ চাপিয়ে দিয়েছেন। নারীদের বোরখার মাধ্যমে আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছে (যদিও পয়গম্বরের আমলে ব্যাপারটি এমন ছিল না), জুয়া ও অ্যালকোহল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, চুরির অপরাধে অপরাধীর অঙ্গচ্ছেদের মত ঐতিহ্যবাহী শাস্তি আইন ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত করা হয়েছে। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র এবং সংগঠন মনে করে না যে কুরানের প্রতি আনুগত্য রক্ষার জন্যে এধরনের প্রাক-আধুনিক শাস্তি ব্যবস্থার জরুরিত্ব আছে। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম ব্রাদারহুড একেবারে গোড়া থেকেই সৌদীদের ইসলামী শাস্তি প্রয়োগকে অযথার্থ আর সেকেলে বলে নিন্দা জানিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে শাসক গোষ্ঠীর বিপুল সম্পদ আর সম্পদের অসম বণ্টন কুরানের আরও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধের বিপক্ষে দাঁড়ায়।
পাকিস্তান ছিল আরেকটি আধুনিক ইসলামী নিরীক্ষা। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ (১৮৭৬-১৯৪৮) আধুনিক সেক্যুলার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। সেই আউরেঙজিবের আমল থেকেই ভারতের মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতার বোধে ভুগে আসছিল, অসন্তুষ্ট ছিল তারা: নিজেদের পরিচয় নিয়ে আতঙ্কে ছিল তারা, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ কর্তৃক উপমহাদেশ বিভক্ত হবার পর এ অবস্থা আরও তীব্র হয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখা দেয়, উভয় পক্ষেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। জিন্নাহ্ এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন মুসলিমরা যেখানে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বারা পরিচিত হবে না বা বাধাগ্রস্থ হবে না। কিন্তু ইসলামী প্রতীক ব্যবহারকারী মুসলিম রাষ্ট্র যদি “সেক্যুলার” হতে চায় কী মানে দাঁড়ায় তাহলে? আবুল আলা মাওদুদি (১৯০৩-৭৯) প্রতিষ্ঠিত জামাত-ই ইসলামী শরিয়াহ্ বিধিমালার কঠোর প্রয়োগের জন্যে চাপ দিয়েছিল এবং ১৯৫৬-তে ঘোষিত সংবিধান পাকিস্তানকে অনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রিপাবলিক পরিচয় দেয়। এক আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করেছিল এটা, যাকে এবার দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে ধারণ করতে হবে। জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খানের সরকার ছিল আমাদের ইতিমধ্যে আলোচিত আগ্রাসী সেক্যুলার মতবাদের একটা সাধারণ উদাহরণ। তিনি ধর্মীয় সম্পদ (ওয়াকফ) জাতীয়করণ করেন, মাদ্রাসা শিক্ষায় বাধানিষেধ আরোপ করেন এবং নিখাদ সেক্যুলার আইনী ব্যবস্থায় উৎসাহ যোগান। তাঁর লক্ষ্য ছিল ইসলামকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের উপযোগী সিভিল ধর্মে পরিণত করা, কিন্তু এতে অনিবার্যভাবে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে টানাপোড়নের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত খানের পতন ডেকে আনে।