রাজনীতি কখনওই ক্রিশ্চান ধর্মীয়বোধের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। অন্তত জেসাস বলেছিলেন তাঁর রাজ্য-এ জগতের নয়। শত শত বছর ধরে ইউরোপের ইহুদিরা নীতিগতভাবে রাজনৈতিক সংশ্রব থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু মুসলিমদের কাছে রাজনীতি গৌণ বিষয় নয়। আমরা দেখেছি বরং এটাই তাদের ধর্মীয় অনুসন্ধানের নাট্যশালা। মোক্ষলাভের অর্থ পাপের মোচন নয়, বরং ন্যায় বিচারভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা যেখানে ব্যক্তি অধিকতর সহজভাবে তার সমগ্র সত্তার অস্তিত্ব সমর্পণ করতে পারবে, যা পূর্ণতা বয়ে আনবে। সুতরাং রাজনীতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার এবং গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে একটা প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্রমাগত প্রয়াস চালানো হয়েছে। কাজটা সবসময়ই কঠিন ছিল। এটা এমন এক আকাঙ্ক্ষা যার জন্য প্রয়োজন জিহাদ-এই সংগ্রাম কোনও সাধারণ ফলাফল বয়ে আনে না।
তাওহীদের আদর্শকে যেন সেক্যুলারিজমের আদর্শের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে হয়েছে, অথচ অতীতে শিয়া ও সুন্নী উভয়েই ধর্ম ও রাজনীতিক পার্থক্য মেনে নিয়েছিল। বাস্তবভিত্তিক রাজনীতি গোলযোগপূর্ণ এবং প্রায়শই নিষ্ঠুর হয়ে থাকে; আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র অনায়াস প্রয়োগযোগ্য কোনও “সহজ বিষয়” নয় বরং রাজনীতির কঠোর বাস্তবতায় কুরানের সমতার আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সৃজনশীল মেধা এবং শৃঙ্খলা প্রয়োজন। পশ্চিমারা যেমন কখনও কখনও মনে করে যে, ইসলামই একটি আধুনিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্র গড়ে তোলার পথে মুসলিমদের পক্ষে অন্তরায়, কথাটা সত্যি নয়। এটাই বরং সত্যি যে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা মুসলিম বিশ্বে একেবারে ভিন্ন ধরনের ছিল। পাশ্চাত্যে এটা সাধারণভাবে কোমল হিসাবে দেখা বা অনুভূত হয়েছে। গোড়ার দিকে জন লকের (John Locke, ১৬৩২-১৭০৪) মত দার্শনিকগণ একে ধার্মিক হবার নতুন উন্নত পথ হিসাবে কল্পনা করেছিলেন, কেননা এতে করে ধর্ম নিপীড়ক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত হয়েছিল এবং ধর্মকে এর আধ্যাত্মিক আদর্শসমূহের প্রতি আরও বিশ্বস্ত করে তুলেছিল। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজম প্রায়শই ধর্ম এবং ধার্মিকের ওপর তীব্র কঠিন আক্রমণের সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ, আতাতুর্ক সকল মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সুফি মতবাদ দমন করেছেন, এবং নারী ও পুরুষ উভয়কে বাধ্য করেছেন আধুনিক পোশাক পরার জন্যে। এ জাতীয় নিপীড়ন সবসময়ই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। টার্কিতে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, স্রেফ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। মুহাম্মদ আলীও মিশরীয় উলেমাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, তাঁদের জমিজমা কেড়ে নিয়েছেন এবং তাঁদেরকে প্রভাব বঞ্চিত করেছেন। পরে জামাল আবদ আল- নাসের (১৯১৮-৭০) কিছু সময়ের জন্যে পুরোদস্তুর জঙ্গিরূপে অ্যান্টি ইসলামীতে পরিণত হয়েছিলেন, দমন করেছেন মুসলিম ব্রাদারহুডকে। সোসায়েটির সন্ত্রাসী অংশের সঙ্গে জড়িত ব্রাদার্সের একজন সদস্য, নাসেরের জীবননাশের প্রয়াস পেয়েছিল, কিন্তু ব্রাদার্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ হাজার হাজার সদস্য আল-নাসেরের নির্যাতন শিবিরে বছরের পর বছর নির্জীব হয়ে পড়লেও লিফলেট বণ্টন বা সভা আহবানের প্রয়াসের চেয়ে জ্বালাময়ী কিছু করতে যায়নি তারা। ইরানে পালভী রাজাগণও তাঁদের সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর ছিলেন। রেযা শাহ্ পালভী (১৯২১-৪১ পর্যন্ত শাসন করেন) উলেমাদের তাঁদের বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং এক সিভিল ব্যবস্থাকে শরিয়া স্থলাভিষ্ণিক্ত করেছেন। হুসেইনের সম্মানে আশুরার উৎসব বাতিল ঘোষণা করেন তিনি এবং ইরানিদের জন্যে হজ্জে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইসলামী পোশাক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়: রেযার সৈন্যরা বেয়োনেট দিয়ে মহিলাদের বোরখা ছিঁড়ে ফেলত আর রাস্তায় ফেলে টুকরো টুকরো করত। ১৯৩৫-এ মাশাদে অষ্টম ইমামের সমাধিতে প্রতিবাদকারীরা পোশাক- আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গেলে সৈন্যরা নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি বর্ষণ করে, ফলে শত শত প্রাণহানি ঘটে। ইরানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার স্বাদ লাভকারী উলেমাগণ তাঁদের প্রভাব হ্রাস দেখতে বাধ্য হন। কিন্তু সংসদীয় সভায় রেযাকে আক্রমণকারী পুরোহিত আয়াতোল্লাহ্ মুদ্দারিস ১৯৩৭-এ শাসকদলের হাতে নিহত হন, ফলে উলেমাগণ প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন। রেযার পুত্র এবং উত্তরাধিকারী মুহাম্মদ রেযা শাহ্ (১৯৪৪-৭৯ পর্যন্ত শাসন করেন) ইসলামের প্রতি সমান বৈরী আর অসন্তুষ্ট বলে প্রমাণিত হন। শাসকের বিরুদ্ধে সাহস করে প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমে আসা শত শত মাদ্রাসা-ছাত্রকে রাজপথে গুলি করে মারা হয়, মাদ্রাসাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং উলেমাদের নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়, কারারুদ্ধ কিংবা নির্বাসনেও পাঠানো হয়েছিল তাঁদের। এই সেক্যুলার শাসনে গণতান্ত্রিক বলে কিছু ছিল না। শাহ্’র গুপ্তপুলিশ বাহিনী SAVAK বিনাবিচারে ইরানিদের কারারুদ্ধ করেছে, তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে, ভীতি প্রদর্শন করেছে এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কোনও সম্ভাবনাই সেখানে ছিল না।
জাতীয়তাবাদ, বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে এসে খোদ ইউরোপীয়রাই যা থেকে সরে যেতে শুরু করেছিল, সেটাও সমস্যামূলক বলে দেখা গেছে। উম্মাহর ঐক্য দীর্ঘদিন ধরে এক মূল্যবান আদর্শ ছিল; এবার মুসলিম বিশ্ব রাজ্য আর প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে গেল, যাদের সীমান্ত পাশ্চাত্য শক্তিগুলো নিজেদের ইচ্ছা মাফিক স্থির করে দিয়েছিল। মুসলিমরা যেখানে নিজেদের অটোমান নাগরিক এবং দার আল- ইসলামের সদস্য বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিল সেখানে একটা জাতীয় চেতনা গড়ে তোলা সহজ ছিল না। কখনও কখনও জাতীয়তাবাদ হিসাবে যা উপস্থাপিত হতে দেখা যায় সেটা একেবারেই নেতিবাচক একটা রূপ গ্রহণ করে, পাশ্চাত্যেকে বাতিল করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় তা। নতুন গড়ে ওঠা জাতিগুলোর কোনও কোনওটি গঠনই এমন ছিল যে নাগরিকদের মাঝে টানাপোড়েন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সুদানের দক্ষিণ অংশ প্রধানত ক্রিশ্চান অধ্যুষিত এলাকা, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল মুসলিম প্রধান। নিজেদের পরিচয় ধর্মের ভিত্তিতে তুলে ধরায় অভ্যস্ত জাতির পক্ষে একটা সাধারণ সুদানিজ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা কঠিনই বটে। এ সমস্যা লেবাননে আরও প্রকট ছিল, এখানে দেশবাসী অন্তত: তিনটি ধর্মীয় গোষ্ঠী– সুন্নী, শিয়া এবং ম্যারোনাইট ক্রিশ্চান-তে বিভক্ত, যারা আবার আগে স্বায়ত্তশাসিত ছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগি অসম্ভব ব্যাপার বলে প্রমাণিত হয়েছে। ডেমোগ্রাফিক টাইম বম্ব গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছে (১৯৭৪-৯০), যার পরিণামে দেশটি দুঃখজনকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অন্যান্য দেশে, যেমন সিরিয়া, মিশর কিংবা ইরাকে, জাতীয়তাবাদ সংখ্যালঘু অভিজাতদের গৃহীত মতবাদ, অধিকতর রক্ষণশীল জনগণ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি। ইরানে পালভীদের জাতীয়তাবাদ সরাসরি ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিল, কেননা তা শিয়া মতবাদের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশটিকে প্রাচীন প্রাক-ইসলামী প্যাগান সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে তুলতে চেয়েছে।