এতক্ষণ আমরা যেসব সংস্কারকদের প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি তাঁরা প্রধানত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর এবং মূলত: শিক্ষিত অভিজাতদের উদ্দেশ্যেই বক্তব্য রেখেছেন। মিশরে তরুণ স্কুলশিক্ষক হাসান আল-বান্না (১৯০৬-৪৯) এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা তাঁদের ধারণাসমূহকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। দ্য সোসায়েটি অভ মুসলিম ব্রাদার্স গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এক গণআন্দোলনের রূপ নেয় এবং সেটাই ছিল একমাত্র আদর্শবাদ যা সেই সময় সমাজের সকল ক্ষেত্রে আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। আল-বান্না জানতেন, মুসলিমদের পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োজন রয়েছে এবং তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান- সমূহের সংস্কার সাধন করতে হবে। কিন্তু অন্যান্য সমাজ সংস্কারকের মত তিনিও বিশ্বাস করেছেন যে একে অবশ্যই আধ্যাত্মিক সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি চলতে হবে। আল-বান্না যখন দেখেন যে ব্রিটিশরা সুয়েয খাল অঞ্চলে বিলাসী জীবনযাপন করছে, তখন মিশরীয় শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনের বৈপরীত্য লক্ষ্য করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একে তিনি ধর্মীয় সমস্যা হিসাবে দেখেছেন যার ইসলামী সমাধান প্রয়োজন। ক্রিশ্চানরা যেখানে প্রায়শই মতবাদসমূহের পরিমার্জনার মাধ্যমে আধুনিকতার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে, মুসলিমরা সেটা করেছে সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রয়াসের (জিহাদ) মাধ্যমে! আল-বান্না জোর দিয়ে বলেছেন যে ইসলাম সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা; ধর্মকে ব্যক্তি পর্যায়ে সীমিত রাখা যাবে না, পাশ্চাত্য যেমন চেষ্টা করেছে। তাঁর সোসায়েটি নতুন যুগের চেতনার উপযোগি হওয়ার জন্যে কুরানকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছে, চেষ্টা করেছে ইসলামী জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের; সামাজিক ন্যায়-বিচারের মান- উন্নয়ন, নিরক্ষরতা আর দারিদ্র্য বিমোচন এবং মুসলিমদের জমি বিদেশী আধিপত্যের কবল থেকে উদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছে। উপনিবেশবাদীদের অধীনে মুসলিমরা হয়ে পড়েছিল উন্মুল। যতদিন তারা অন্যদের অনুকরণ করে চলবে ততদিন পর্যন্ত তারা সাংস্কৃতিক সংকর হয়ে থাকবে। ব্রাদার এবং সিস্টারদের আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা আর কুরান-অনুযায়ী জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি আল-বান্না স্কুল নির্মাণ করেছেন, আধুনিক স্কাউট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন, শ্রমিকদের জন্যে নৈশ স্কুল আর সরকারী চাকুরির উপযুক্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে টিউটোরিয়াল কলেজ পরিচালনা করেছেন। দ্য ব্রাদার্স গ্রামাঞ্চলে ক্লিনিক এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে; কারখানা নির্মাণ করেছে, যেখানে মুসলিমরা সরকারী খাতের তুলনায় বেশী হারে বেতন, স্বাস্থ্য বীমা আর ছুটি পেত; এবং মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম করে তোলার উদ্দেশ্যে আধুনিক শ্রম আইন শিক্ষা দিয়েছে।
সোসায়েটির ত্রুটিও ছিল। ছোট একটা গ্রুপ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ছিল যা এর বিলুপ্তি ডেকে এনেছিল প্রায় (যদিও ভিন্ন প্রয়াসের অধীনে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে)। কিন্তু অধিকাংশ সদস্য –১৯৪৮ নাগাদ যা কয়েক মিলিয়ন মুসলিমে দাঁড়িয়েছিল –এইসব অপকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানত না, তারা তাদের কল্যাণ ও ধর্মীয় কার্যক্রমকে প্রয়োজনীয় হিসাবে বিবেচনা করেছে। সোসায়েটির ত্বরিৎ সাফল্য দেখায় যে- যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিশরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল- সিংহভাগ জনগণ আধুনিক এবং ধার্মিক হতে চায়, বুদ্ধিজীবীগণ বা সেক্যুলার সরকারসমূহ যেমনটিই মনে করুক না কেন। এই ধরনের সামাজিক কার্যক্রম বহু আধুনিক ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যে পরণত হয়েছিল যার অন্যতম হচ্ছে গাযায় শেখ আহমেদ ইয়ামিন প্রতিষ্ঠিত মুজামাহ্ (ইসলামীক কংগ্রেস) যা ১৯৬৭-র জুন মাসে সংঘটিত যুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক দখল করে নেয়া অঞ্চলে প্যালেস্টাইনীদের কাছে আধুনিকতার সুবিধাদি পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইসলামী প্রেক্ষিতে একইরকম কল্যাণ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল।
আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্র কী?
ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপের সঙ্গে সংঘাত ইসলামী সমাজকে স্থানচ্যুত করে দিয়েছিল। অপরিবর্তনীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল পৃথিবী। পাশ্চাত্যের প্রতি কীভাবে সাড়া দেয়া উচিত মুসলিমদের পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কেননা চ্যালেঞ্জটা ছিল নজীরবিহীন। মুসলিমদের যদি আধুনিক বিশ্বের পূর্ণাঙ্গ অংশীদার হিসাবে অংশগ্রহণ করতে হয় সেক্ষেত্রে তাদের এসব পরিবর্তন আত্মস্থ করতে হত। বিশেষ করে, পাশ্চাত্য রক্ষণশীল ধর্মের প্রতিবদ্ধকতা হতে সরকার, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে রক্ষা করার জন্যে ধর্ম ও রাজনীতির বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন বলে আবিষ্কার করেছিল। ইউরোপে জাতীয়তাবাদ ধর্মের প্রতি আনুগত্যের স্থান দখল করেছিল, যা এর সমাজগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম করেছে। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর এই নিরীক্ষা সমস্যাসঙ্কুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপের জাতি রাষ্ট্রগুলো ১৮৭০-এ এক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় যা শেষ পর্যন্ত দু-দুটো বিশ্ব- যুদ্ধ ডেকে আনে। সেক্যুলার আদর্শসমূহও পুরনো ধর্মীয় গোঁড়ামির মতই মারাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে, যা নাৎসি হলোকাস্ট আর সোভিয়েত গুলাগে (Gulag) স্পষ্ট হয়ে গেছে। আলোকনপর্বের ফিলোসোফদের (Philosophes) ধারণা ছিল যে মানুষ যত শিক্ষিত হয়ে উঠবে ততই তারা যুক্তিবাদী ও সহিষ্ণু হবে। এ আশা প্রাচীনকালের যেকোনও মেসিয়ানিক কল্পনার মতই শূন্যগর্ভ বলে প্রমাণিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আধুনিক সমাজ গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে এবং তা মোটামুটিভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণের জীবন অনেক বেশী ন্যায়ভিত্তিক এবং সাম্যবাদী করে তুলেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের জনগণ গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে শত শত বছর সময় পেয়েছিল। কিন্তু এখনও প্রবলভাবে কৃষিপ্ৰধান বা অপরিণত আধুনিক সমাজে আধুনিক পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হলে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আধুনিক রাজনৈতিক ডিসকোর্সকে উপলব্ধির অতীত বলে মনে করে।