নারী মুক্তির প্রয়াস ছিল পয়গম্বরের হৃদয়ের অংশ। পাশ্চাত্যের নারীদের বহু শতাব্দী আগেই কুরান মহিলাদের সম্পদের উত্তরাধিকার এবং স্বামী বিচ্ছেদের ক্ষমতা দিয়েছে। কুরান পয়গম্বরের স্ত্রীগণের নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতা ও পর্দার কথা বলেছে, কিন্তু কুরানে এমন কিছু নেই যা সকল নারীর জন্য পর্দার আবশ্যকতা বা তাদের বাড়ির আলাদা অংশে বিচ্ছিন্ন রাখার কথা বলে ৷ পরলোকগমনের প্রায় তিন কি চার প্রজন্ম পরবর্তী সময়ে এই রীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মুসলিমরা সেই সময় বাইযানটিয়ামের গ্রিক ক্রিশ্চানদের অনুকরণ করছিল, যারা তাদের মহিলাদের এভাবে দীর্ঘ আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখত; তারা তাদের ক্রিশ্চান নারী বিদ্বেষও খানিকটা আয়ত্ত করেছিল। কুরান নারী- পুরুষকে ঈশ্বরের সামনে অংশীদার বানিয়েছে, যাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য একই রকম[১২] কুরান বহুগামিতাকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে এসেছে এমন এক সময়ে যখন মুসলিমরা মক্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছিল এবং যার ফলে নারীরা আশ্রয়হীনা হয়ে পড়েছিল; পুরুষদের চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়, যদি তারা সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে পারে এবং কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব না দেখায়।[১৩] মদীনায় প্রথম উম্মাহর নারী সদস্যারা প্রকাশ্য জীবনে পুরোপুরি অংশ নিয়েছে এবং কেউ কেউ আরবের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী রণক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধও করেছে। তারা ইসলামকে নিপীড়নমূলক ধর্ম বলে মনে করেছিল বলে মনে হয় না৷ যদিও পরবর্তীকালে, ক্রিশ্চান ধর্মের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে, পুরুষরা ধর্মবিশ্বাসকে ছিনতাই করে এবং একে বিরাজিত পুরোহিত তন্ত্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়।
মদীনার প্রাথমিক বছরগুলোতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটে। মুহাম্মদ (স:) ইহুদি গোত্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সম্ভাবনায় দারুণ উত্তেজিত ছিলেন এবং এমনকি, হিজরার অব্যবহিত আগে কিছু কিছু রেওয়াজ (যেমন শুক্রবার অপরাহ্নে সমবেত প্রার্থনা, এসময় ইহুদিরা সাবাথের প্রস্তুতি গ্রহণ করত এবং ইহুদি প্রায়শ্চিত্ত দিবসে উপবাস পালন করত) যোগ করেন যাতে ইসলামকে আরও বেশী জুডাইজমের সঙ্গে মেলানো যায়। মদীনার ইহুদিরা যখন তাঁকে সত্য পয়গম্বর হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল, জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। ইহুদিদের কাছে পয়গম্বরত্বের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং মুহাম্মদকে(স:) স্বীকার করে নিতে না চাওয়াটা তাদের পক্ষে বিস্ময়কর ছিল না। তবে মদীনাবাসী ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুক্তিসমূহ কুরানের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে আছে যা দেখায় যে ব্যাপারটি মুহাম্মদকে(স:) উৎকণ্ঠিত করে তুলেছিল। নোয়াহ্ ও মোজেসের মত পয়গম্বরদের কাহিনী বাইবেলের তুলনায় ভিন্নভাবে কুরানে উপস্থাপিত হয়েছে। এসব বিবরণ যখন মসজিদে আবৃত্তি করা হত তখন ইহুদিরা বিদ্রূপ করত। ইহুদি গোত্রগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি গোত্র মুহাম্মদের(স:) উত্থানে বিক্ষুব্ধ ছিল, বসতিতে তাঁর আগমনের আগে একটা শক্তিশালী জোট গড়ে তুলেছিল তারা, এখন তারা নিজেদের অপদস্থ ভেবে মুহাম্মদকে(স:) অপসারণ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল।
কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট ক্ল্যানগুলোর কোনও কোনও ইহুদি বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, তারা ইহুদি ঐশীগ্রন্থ সম্পর্কে মুহাম্মদের(স:) জ্ঞান সমৃদ্ধ করে তোলে। বুক অভ জেনেসিসে আব্রাহামের দুই পুত্র: ইসহাক ও ইশমায়েল (আরবীতে যাঁর নাম ইসমায়েল হয়েছে), উপপত্নী হ্যাঁগারের (হাজেরা) সন্তান ছিলেন জানতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছিলেন তিনি। হ্যাঁগার এবং ইসমায়েলকে বিরান প্রান্তরে নির্বাসন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আব্রাহাম, কিন্তু ঈশ্বর তাদের রক্ষা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ইসমায়েলও এক মহান জাতি-আরবদের পিতা হবেন।[১৪] স্থানীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী সবাই জানত যে হ্যাঁগার এবং ইসমায়েল মক্কায় বসতি করেছিলেন আর আব্রাহাম সেখানে তাদের দেখতে এসেছেন এবং আব্রাহাম ও ইসমায়েল মিলিতভাবে কাবাহ্ (যা আদিতে অ্যাডাম নির্মাণ করেছিলেন-কিন্তু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল) নির্মাণ করেন।[১৫] মুহাম্মদের(স:) কাছে একাহিনী অসাধারণ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আরবরা আসলে স্বর্গীয় পরিকল্পনা হতে বাদ পড়েনি এবং কাবার শ্রদ্ধা করার মত একেশ্বরবাদী পরিচয় রয়েছে।
৬২৪ সাল নাগাদ এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে মদীনার সংখ্যা গরিষ্ঠ ইহুদি কখনওই পয়গম্বরের সঙ্গে সমন্বয়ে আসবে না। মুহাম্মদও(স:) একথা জানতে পেরে হতাশ হয়েছিলেন যে ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের (যাদের তিনি একই ধর্ম বিশ্বাসের ধারক ধরে নিয়েছিলেন) মাঝে আসলে তীব্র ধর্মতাত্ত্বিক পার্থক্য রয়েছে, যদিও তাঁর এমন ধারণা জন্মেছিল বলে মনে হয় যে, সকল আহল আল-কিতাব এই অমর্যাদাকর বিভেদ স্বীকার করে না। জানুয়ারি ৬২৪-এ তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নেন যা ছিল তাঁর অন্যতম সৃজনশীল কর্ম। সালাত প্রার্থনার সময় গোটা জমায়েতকে তিনি উল্টোদিকে ঘোরার আদেশ দেন, ফলে জেরুজালেমের পরিবর্তে মক্কার দিকে ফিরে প্রার্থনা করে তারা। তাঁর কিবলা এই পরিবর্তন ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা। জেরুজালেম থেকে মুখ ফিরিয়ে কাবার দিকে, যার সঙ্গে জুডাইজম বা ক্রিশ্চানটির কোনওই সম্পর্ক ছিল না, ঘোরার মাধ্যমে মুসলিমরা নীরবে দেখিয়ে দিয়েছিল যে তারা আব্রাহামের খাঁটি এবং আদি একেশ্বরবাদের দিকে ফিরে যাচ্ছে, যিনি তোরাহ্ কিংবা গসপেলের প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হওয়ার আগেই জীবনযাপন করে গেছেন, ঈশ্বরের ধর্ম বিভিন্ন বিবদমান গোত্রে ভাগ হওয়ার আগের সময় সেটা।[১৬] মুসলিমরা একমাত্র ঈশ্বরের দিকেই ধাবিত হবে: স্বয়ং ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে কোনও মানব সৃষ্ট ব্যবস্থা বা কোনও প্রতিষ্ঠিত ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করা বহুঈশ্বরবাদীতা: