ইউরোপীয় ও আমেরিকানরা যেখানে তাদের নিজস্ব গতিতে আধুনিকীকরণ এবং নিজস্ব কর্মসূচি স্থির করার সুযোগ পেয়েছিল, ঔপনিবেশিক দেশগুলোর অধিবাসীদের সেখানে অনেক বেশী দ্রুত আধুনিক হতে হয়েছে এবং তাদের ভিন্ন কারও কর্মসূচি পরিপালনে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এমনকি পাশ্চাত্যের জনগণের কাছেও তাদের সমাজের পরিবর্তন বেদনাদায়ক ছিল। প্রায় চারশো বছরব্যাপী রাজনৈতিক এবং প্রায়শ রক্তাক্ত অভ্যূত্থান, সন্ত্রাসের রাজত্ব, গণহত্যা, ধর্মীয় সহিংসতা, গ্রামাঞ্চলের লুণ্ঠন কার্যক্রম, ব্যাপক সামাজিক উত্থান-পতন, কলকারখানায় শোষণ, আধ্যাত্মিক অস্থিরতা আর নতুন মেগাসিটি সমূহের গভীর বৈরিতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল তাদের। আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অনুরূপ সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা, অভ্যত্থান এবং দিশাহারা অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, যা আধুনিককালে উত্তোরণের যাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। একথাও সত্যি যে, পাশ্চাত্যে বিকাশ লাভ করা আধুনিক চেতনা মৌলিকভাবে আলাদা। ইউরোপ এবং আমেরিকায় এর প্রধান দু’টি বৈশিষ্ট্য ছিল: উদ্ভাবন এবং স্বায়ত্তশাসন (ইউরোপ ও আমেরিকায় আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ফ্রন্টে স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে)। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া স্বায়ত্ত শাসনের অনুগামী হয়নি বরং তা স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। উদ্ভাবনের পরিবর্তে উন্নয়নশীল দেশগুলো কেবল পশ্চিমকে অনুকরণের মাধ্যমে আধুনিক হতে পারে, যা এত বেশী অগ্রসর ছিল যে নাগাল পাওয়ার কোনও আশাই তাদের ছিল না। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া যেহেতু এক ছিল না, সুতরাং ফলাফল যে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে যা প্রত্যাশিত-ধরণ সেকরম কিছু হবে, এমন সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। কেকের সঠিক উপাদানসমূহ যদি পাওয়া না যায়- যদি ময়দার বদলে চাল আর তাজা ডিমের বদলে পচা ডিম, চিনির জায়গায় মসলা ব্যবহার করা হয়- রান্নার বইতে দেয়া কেকের বর্ণনার সঙ্গে অনেক তফাৎ থাকবে ফলাফলের। ঔপনিবেশিক দেশগুলোর আধুনিক কেকে একেবারে ভিন্ন রকম উপাদান যোগ হয়েছিল; গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম, বহুত্ববাদ এবং অন্যান্য ফলাফল পশ্চিমে যেভাবে বেরিয়ে এসেছিল এই প্রক্রিয়ায় সেরকম কিছু বেরিয়ে আসার কথা নয়।
আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ইসলামী বিশ্ব প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে। বিশ্ব সভ্যতার অন্যতম নেতৃত্বের আসন লাভ করার পরিবর্তে ইসলামী জগৎ দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর নির্ভরশীল বলয়ে পর্যবসিত হয়ে পড়েছিল। উপনিবেশবাদীদের অসন্তোষের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল মুসলিমরা। পশ্চিমারা আধুনিক রীতিনীতিতে এমনভাবে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল যে, প্রায়শ তারা তাদের চোখে মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা, অদক্ষতা, অদৃষ্টবাদ আর দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করে হতবাক হয়ে গেছে। তারা ধরে নিয়েছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি সবসময়ই প্রাগ্রসর ছিল, তাদের এটা বোঝার মত ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না যে, কেবল প্রাক-আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ দেখছে তারা এবং কয়েক শতাব্দী আগে ইউরোপও একই রকম “পশ্চাদপদ” ছিল। তারা এটা প্রায়ই নিশ্চিতভাবে ধরে নেয় যে, পশ্চিমারা উত্তরাধিকারসূত্রে এবং জাতিগতভাবে “ওরিয়েন্টালদের” তুলনায় উন্নত এবং নানাভাবে তারা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব অস্বাভাবিক ছিল না। পাশ্চাত্যের জনগণ প্রায়ই তাদের সংস্কৃতির প্রতি মুসলিমদের বৈরী অনুভূতি আর বিদ্বেষ লক্ষ্য করে হতবাক হয়ে যায়, যাকে তারা তাদের ভিন্নতর অভিজ্ঞতার কারণে খুবই উদারনৈতিক আর ক্ষমতাপ্রদানকারী বলে মনে করে। কিন্তু মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক নয়; কারণ ইসলামী বিশ্ব এমন সুবিস্তৃত আর কৌশলগতভাবে বিস্তৃত ছিল যে, এবারই প্রথম এক সমন্বিত, পদ্ধতিগত উপায়ে মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, আরব, মালয় এবং আফ্রিকার উল্লেখযোগ্য অংশ উপনিবেশকরণের প্রক্রিয়ার অধীনে পড়েছিল। এসব অঞ্চলের মুসলিমরা এই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার আক্রমণের প্রথম আঁচ টের পেয়েছে। তাদের প্রতিক্রিয়া নতুন পশ্চিমের প্রতি সামান্য সাড়ামাত্র ছিল না, বরং তা ছিল দৃষ্টান্তমূলক প্রতিক্রিয়া। তারা, উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জাপানের মত সাফল্যের সঙ্গে বা মসৃণভাবে আধুনিক যুগে উঠে আসতে পারেনি–জাপান কখনও উপনিবেশে পরিণত হয়নি, জাপানের অর্থনীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ অটুট রয়ে গিয়েছিল, যেগুলো শক্তি হারিয়ে পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়নি।
ইসলামী বিশ্বের ওপর ইউরোপীয় আগ্রাসন সবক্ষেত্রে একরকম ছিল না; কিন্তু সেটা ছিল সম্পূর্ণ এবং কার্যকর। সূচনা হয়েছিল মোঘুল ভারতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ বণিকের দল রেঙ্গুনে শেকড় গাড়ে এবং সেই সময়, আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া যখন শিশু অবস্থায়, ব্রিটিশরা হিন্দু ও মুসলিম বণিকদের সমান পর্যায়েই বসবাস করেছে। কিন্তু ব্রিটিশদের এই কার্যকলাপ “বাংলার লুণ্ঠন প্রক্রিয়া” হিসাবে পরিচিতি, কেননা এর ফলে স্থানীয় শিল্পক্ষেত্রগুলো স্থায়ীভাবে ক্ষত্রিগ্রস্ত হয় আর কৃষিখাতকে এমনভাবে বদলে দেয় যে, বাঙালীরা তখন আর নিজেদের জন্যে শস্য উৎপাদন করছিল না, উৎপাদন করছিল শিল্পায়িত পশ্চিমা বাজারসমূহের কাঁচামাল। বিশ্বের অর্থনীতিতে বাংলার অবস্থান নেমে এসেছিল দ্বিতীয় কাতারে। আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা আরও “আধুনিক” হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে দক্ষ; তাদের হাবভাবে উন্নততর অভিব্যক্তি যোগ হয় এবং তারা ১৭৯৩-তে আগত প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারিদের সমর্থনে ভারতীয়দের “সভ্য” বানাতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু বাঙালীদের তাদের নিজস্ব সম্পূর্ণ শিল্পায়িত সমাজ গঠনে উৎসাহিত করা হয়নি; ব্রিটিশ প্রশাসকরা আধুনিক প্রযুক্তির কেবল সেইসব উপাদানগুলোই যোগ করেছিল, যাতে করে তাদের প্রাধান্য নিশ্চিত হয় এবং বাংলাকে পরিপূরকের ভূমিকায় রাখা যায়। ব্রিটিশদের দক্ষতা থেকে বাঙালীরা লাভবান হয়েছিল, যা রোগশোক, দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধের মত বিপর্যয়গুলোকে দূরে ঠেলে রেখেছিল, এর ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এতে করে জনসংখ্যাধিক্য ও দারিদ্র্যের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেহেতু পাশ্চাত্যের মত শহরে অভিবাসী হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, সবাইকে যার যার এলাকাতেই রয়ে যেতে হয়েছিল।