সমাজের আধুনিকীকরণের সঙ্গে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন জড়িত। দক্ষতাই হচ্ছে মূল কথা, যে কোনও উদ্ভাবন বা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় সংগঠন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে কিনা সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়। মানুষের ক্রমবর্ধমান হারে ব্যাপক ভিত্তিতে পরিচালিত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও শিল্প প্রকল্পে অংশ নেয়ার প্রয়োজন পড়েছে- মুদ্রক, কেরানি, কারখানা শ্রমিক- আর নতুন মানদণ্ডের কিঞ্চিৎ অংশীদার হওয়ার জন্য তাদের কোনও না কোনও শিক্ষা গ্রহণ করার দরকার হয়েছে। ব্যাপক ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্য কেনার জন্যে অধিক সংখ্যক লোকের প্রয়োজন হয়েছে, তো অর্থনীতিকে চালু রাখার স্বার্থে মানুষজনকে ক্রমবর্ধমান হারে জীবনযাত্রার ন্যূনতম পর্যায়ের ঊর্ধ্বে থাকতে হয়েছে। শ্রমিরা অধিক সংখ্যায় শিক্ষিত হয়ে ওঠায় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণের অধিকার দাবী করেছে। কোনও জাতি যদি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর মানবসম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার ঘটাতে চায়, তাহলে তাকে এতদিন পর্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়ে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা গ্রুপগুলোকে যেমন, ইহুদিদের, সাংস্কৃতির মূলধারার অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং আধ্যাত্মিক আদর্শসমূহকে অবশ্যই কোনওভাবেই সমাজের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে দেয়া যাবে না, তো বিজ্ঞানী, রাজা এবং সরকারী কর্মচারীগণ দাবী তুললেন যে তাঁদের গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে দিতে হবে। এভাবে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, সহিষ্ণুতা, মানবাধিকার আর সেক্যুলারিজমের আদর্শগুলো কেবল রাজনীতি-বিজ্ঞানীদের স্বপ্নের সুন্দর সুন্দর আদর্শ স্বপ্নই ছিল না, বরং সেগুলো অন্তত: অংশতঃ আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনেরই প্রকাশ ছিল। দেখা গেছে যে দক্ষ এবং উৎপাদনশীল হওয়ার জন্যে আধুনিক কোনও জাতিকে সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে সংগঠিত করা দরকার। আবার এটাও দেখা গেছে যে, বিভিন্ন সমাজ যদি তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহকে নয়া যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক নিয়মানুসারে সংগঠিত করে, তাহলে সেগুলো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে; প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজগুলো যার ধারে কাছে আসার যোগ্যতা রাখে না।
ইসলামী জগতের ওপর এর প্রভাব ছিল মারাত্মক। আধুনিক সমাজের প্রগতিশীল প্রকৃতি আর শিল্পায়নকৃত অর্থনীতির মানে ছিল একে অবিরাম সম্প্রসারিত হতে হবে। নতুন নতুন বাজারের প্রয়োজন ছিল এবং একবার অভ্যন্ত রীণ বাজারগুলো সম্পৃক্ত হয়ে গেলে বাইরে বাজার অনুসন্ধান করতে হয়েছে তাদের। সুতরাং পশ্চিমা দেশগুলো নানাভাবে আধুনিক ইউরোপের বাইরে কৃষিভিত্তিক দেশগুলোকে বাণিজ্যিক নেটওঅর্কের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে উপনিবেশে পরিণত করতে শুরু করে। এটাও বেশ জটিল প্রক্রিয়া ছিল। উপনিবেশাধীন দেশগুলো রপ্তানির জন্যে কাঁচামালের যোগান দিয়েছিল যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ইউরোপীয় শিল্পখাতে। বিনিময়ে সেই দেশ সস্তায় ইউরোপীয় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী লাভ করেছে, যার মানে ছিল সাধারণভাবে স্থানীয় শিল্পখাতের বিনাশ। উপনিবেশকে আবার ইউরোপীয় কায়দায় পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণের প্রয়োজন ছিল, দরকার ছিল এর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জীবনধারাকে যৌক্তিককরণের ভেতর দিয়ে পাশ্চাত্য ব্যবস্থাধীনে আনার এবং অন্তত “নেটিভদের” একটা অংশের আধুনিক ধ্যান-ধারণা আর রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে হয়েছিল।
এই উপনিবেশ স্থাপন প্রক্রিয়া কৃষিভিত্তিক উপনিবেশগুলো আগ্রাসী, অস্বস্তিকর এবং অচেনা বলে মনে করেছে। আধুনিকীকরণের ব্যাপারটা অনিবার্যভাবে উপরিগত (Superficial) ছিল, কেননা যে প্রক্রিয়াটি ইউরোপে তিন শত বছর ধরে চলেছে- তা দ্রুত গতিতে অর্জন করা জরুরি ছিল। ইউরোপে আধুনিক ধারণাসমূহ যেখানে সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে আস্তে আস্তে পৌঁছানোর সময় পেয়েছিল, উপনিবেশগুলোয় সেখানে নগণ্য সংখ্যক মানুষ, যারা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সদস্য ছিল এবং- তাৎপর্যপূর্ণভাবে- সামরিক বাহিনী, পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে আর আধুনিকতার গতিশীলতা উপলব্ধি করতে পেরেছে। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রয়োজনবোধেই প্রাচীন কৃষিভিত্তিক রীতিনীতিতে পচতে দেয়া হয়েছে। সুতরাং সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে, ক্রমবর্ধমান হারে পরস্পরকে বুঝতে পারেনি। যাদের আধুনিকীকরণের বাইরে রেখে দেয়া হয়েছিল তারা অস্বস্তির সঙ্গে লক্ষ্য করেছে যে তাদের দেশ কেমন যেন একেবারেই অচেনা হয়ে যাচ্ছে, যেন রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক কাঠামো বিকৃত হয়ে অপরিচিত হয়ে যাওয়া কোনও বন্ধু। বিদেশী সেক্যুলার আইন দ্বারা শাসিত হয়েছে তারা যেগুলো ছিল তাদের বোধের অতীত। তাদের শহরগুলো বদলে গিয়েছিল, পশ্চিমা দালানকোঠা শহরগুলোকে “আধুনিক করেছে”, প্রায়শ “পুরনো নগরী” গুলোকে রেখে দিয়েছে জাদুঘরের বিষয় হিসাবে, যেগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ-বস্তু বা ফেলে আসা সময়ের রেলিক। পশ্চিমা পর্যটকরা প্রায়ই ওরিয়েন্টাল নগরীর আঁকাবাঁকা গলিপথ আর আপাত কোলাহলে দিশাহারা এবং উন্মুল অনুভব করে: তারা এটা সবসময় বুঝতে পারে না যে, দেশীয় অনেকের চোখেও তাদের আধুনিককৃত রাজধানীগুলোকে একই রকম অচেনা মনে হয়। জনগণ নিজের দেশেই নিজেদের ঠিকানাবিহীন মনে করেছে। সর্বোপরি সমাজের সকল শ্রেণীর স্থানীয় জনগণ নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণের অধিকার হারিয়ে ফেলার কথাটা মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করেছে শেকড়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছে, আত্মপরিচয় খোয়ানোর বোধ জেগেছিল তাদের মাঝে।