শতাব্দীর পর শতাব্দী বাইযানটাইন সাম্রাজ্য, মুসলিমরা যাকে “রাম” (রোম) বলে অভিহিত করত, ইসলামকে ঠেকিয়ে রেখেছিল। একের পর এক খলিফাহ্ পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এবার “মেহমেদ দ্য কনকোয়েরার” পুরনো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিলেন। এক নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছাল তখন মুসলিমরা। মঙ্গোল-বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে নতুন এক শক্তির সন্ধান পেল তারা। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইসলামী জগৎ বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পূর্ব-ইউরোপে ঢুকে পড়েছিল তা, মুসলিম বণিকদের সুবাদে ইউরেশিয়ান প্রান্তরে আর সাব-সাহারান আফ্রিকায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম বণিকগণ পূর্ব-আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল, দক্ষিণ আরব এবং ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিম উকূলবর্তী এলাকায়ও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল। মুসলিম বণিকগণ, প্রত্যেকেই ধর্মের একেকজন প্রচারক, এমন একটা সময়ে মালয়ে বসতি করে যখন সেখানে বুদ্ধদের বাণিজ্য ভেঙে পড়েছিল, অচিরেই তারা যারপরনাই মর্যাদার অধিকারী হয়ে ওঠে। সুফি ধর্মপ্রচারকগণ ব্যবসায়ীদের অনুসরণ করে এবং চতুদর্শ ও পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ মালয় মুসলিম আধিপত্যের দেশে পরিণত হয়। গোটা বিশ্বই ইসলামী হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছিল: এমনকি যারা মুসলিম শাসনাধীনে ছিল না তারাও আবিষ্কার করেছিল যে মুসলিমরা মহাসাগরগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং নিজের দেশ ছেড়ে বের হতে গেলেই ইসলামী রাজ্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমনকি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর সূচনার দিকে ইউরোপীয় নাবিকরা যখন বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলো করছে, তখনও তারা মুসলিমদের সাগরপথ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। ইসলামকে অপরাজেয় মনে হয়েছে যেন। মুসলিমরা এখন নয়া সাম্রাজ্যসমূহ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত, যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বাধুনিক।
তথ্যসূত্র
১. কায়রোর ইসমায়েলি রাজবংশকে প্রায়শ “ফাতিমীয়” রাজবংশ বলে অভিহিত করা হয়, কারণ দ্বাদশবাদীদের মত ইসমায়েলিরা আলী ও পয়গম্বরের কন্যা ফাতিমার প্রত্যক্ষ বংশধর ইমামদের শ্রদ্ধা করত।
২. কুরান ২:১০৯ (বাংলা অনুবাদে ১১৫- অনুবাদক)।
৩. আল-মুকাদ্দিমাহ, ইউসেফ এম. চৌউয়েরি, ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজম (লন্ডন ১৯৯০) ১৮-এ উদ্ধৃত
৫. প্রতিরুদ্ধ ইসলাম
৫. প্রতিরুদ্ধ ইসলাম
পশ্চিমের আবির্ভাব (১৭৫০-২০০০)
পাশ্চাত্যের উত্থান বিশ্বের ইতিহাসে নজীর বিহীন। আল্পসের উত্তরাঞ্চলীয় দেশগুলো শত শত বছর ধরে পশ্চাদপদ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছিল, দক্ষিণের গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত রেখেছিল নিজেদের। এবং ক্রমশ নিজস্ব ভিন্ন রূপের খ্রিস্টধর্ম এবং নিজস্ব ধরনের কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। পশ্চিম ইউরোপ ক্রিশ্চান বাইযানটাইন সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল, ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্য ধসে পড়লেও সেখানে সেরকম ঘটেনি। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ পশ্চিম ইউরোপীয় এই দেশগুলো অন্যান্য প্রধান সংস্কৃতিক সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেছিল মাত্র এবং ষোড়শ শতাব্দীর দিকে এক ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে যা পাশ্চাত্যকে অবশিষ্ট বিশ্বকে আপন প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসার যোগ্য করে তুলেছে। একটা আউটগ্রুপের পক্ষে এমন ঊর্ধ্বারোহণের সাফল্য অসাধারণ ব্যাপার ৷ সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী কালে আরব মুসলিমদের প্রধান পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। কিন্তু মুসলিমরা বিশ্ব শাসনের অধিকার অর্জন করতে পারেনি, বা নতুন ধরনের সভ্যতারও বিকাশ ঘটায়নি যেমনটি ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল।
অটোমানরা যখন ইউরোপের হুমকি মোকাবিলায় আবার তাদের সেনাবাহিনীকে পূর্নগঠনের প্রয়াস পেয়েছিল তখন তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার কারণ সেটা ছিল কেবল উপরিতলের পরিবর্তন। ইউরোপকে তার নিজের খেলায় হারানোর জন্যে প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজের আপাদমস্তক পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল এর সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক এবং মননশীলতার গোটা কাঠামোর পুননির্মাণের এবং সেটা করা উচিত ছিল খুব দ্রুততার সঙ্গে; যা ছিল অসম্ভব একটা কাজ, কেননা এই পরিবর্তন অর্জনের পেছনে পাশ্চাত্যের তিনশো বছরেরও বেশী সময় লেগেছিল।
ইউরোপ এবং এর আমেরিকান কলোনিগুলোর নতুন সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপন্নের ওপর নির্ভর না করে বিশেষ প্রযুক্তি এবং পুঁজি বিনিয়োগের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল তা; পাশ্চাত্যকে যা এর সম্পদ সীমাহীন মাত্রায় পুনরুৎপাদনে সক্ষম করে তুলেছিল, যার ফলে পাশ্চাত্য সমাজ আর কৃষিভিত্তিক সমাজের সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতার ফাঁদে বাধা পড়েনি। বাস্তবিকপক্ষে এই প্রধান বিপ্লব দ্বিতীয়বারের মত অ্যাক্সিয়াল যুগের সৃষ্টি করেছিল, যার দাবী ছিল একই সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত রাতিনীতির ব্যাপক অদলবদল: রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। আগেভাগে চিন্তা করা হয়নি এসব বা কোনও পরিকল্পনাও ছিল না, বরং তা এক জটিল প্রক্রিয়ারই পরিণতি যার ফলে জন্ম নিয়েছে গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার সামাজিক কাঠামো। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব অর্জন করে ইউরোপীয়রা যা তাদের পরিবেশের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ লাভে সক্ষম করে তোলে, এর আগে কেউ যা পারেনি। চিকিৎসাবিজ্ঞান, নৌযাত্রা, কৃষিক্ষেত্র আর শিল্পজগতে নতুন নতুন আবিষ্কার আর উদ্ভাবন ঘটে। এগুলোর কোনওটিই বিচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তনে সক্ষম নয়, কিন্তু এগুলোর সমন্বিত ফলাফল ছিল মারাত্মক। ১৬০০ সাল নাগাদ উদ্ভাবনের মাত্রা এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে প্রগতিকে মনে হয়েছে অপ্রতিরোধ্য; কোনও একটি ক্ষেত্রে কোনও একটি আবিষ্কার অন্যক্ষেত্রে আনকোরা নতুন দর্শনের দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশ্বকে অপরিবর্তনীয় আইনের অধীন হিসাবে না দেখে ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করল যে তারা প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি-সৃষ্ট রক্ষণশীল সমাজের যেখানে এধরনের পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষমতা ছিল না, ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ সেখানে আরও বেশী মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিল। তারা এবার অবিরাম প্রগতি আর বাণিজ্যের অব্যাহত উন্নয়নের দৃঢ় আশা নিয়ে পুঁজির বিনিয়োগ ও পুনঃবিনিয়োগের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। এই সময় নাগাদ সমাজের প্রযুক্তিকরণের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব জন্ম লাভ করে, পাশ্চাত্য এমনই আত্মবিশ্বাস বোধ করতে শুরু করে যে অনুপ্রেরণার আশায় তাদের আর অতীতের মুখাপেক্ষী থাকার প্রয়োজন পড়েনি –যেমনটি কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি বা ধর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়– বরং তারা তাকিয়েছে ভবিষ্যতের দিকে।