কেউই টিমুরের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বিশ্ব জয় তখনও এক অসম্ভব স্বপ্ন রয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে গানপাউডারের আবিষ্কার মুসলিম শাসকদের পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বৃহৎ কিন্তু অধিকতর নিয়ন্ত্রণযোগ্য সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সফল করে তুলেছিল। এখানেও ইসলামের সঙ্গে মঙ্গোল আদর্শের মিশ্রণের প্রয়াস ছিল। এসব নতুন সাম্রাজ্য ভারত, আযেরবাইজান এবং আনাতোলিয়ায় ভিত্তি পেয়েছিল।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লীর সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সুদূর রেঙ্গুন পর্যন্ত গাঙ্গেয় উপত্যকায় ইসলাম ভালোভাবেই শেকড় গেড়ে বসে। পার্বত্য এলাকা সমূহের নগণ্য সংখ্যক হিন্দু রাজপুত, ভারতীয় শাসক শ্রেণী, দূরত্ব বজায় রেখেছিল, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মুসলিম আধিপত্য মেনে নেয়। যেমন মনে হয়, ব্যাপারটা ততটা বিস্ময়কর ছিল না। জাতপ্রথা রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুশীলন মুষ্টিমেয়ে পরিবারের হাতে সীমিত রেখেছিল এবং এই পরিবারগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পর হিন্দুরা তাদের জায়গায় যেকাউকে গ্রহণ করার জন্যে প্রস্তুত ছিল, যদি তাতে তাদের জাতপ্রথার বিধিবিধান লঙ্ঘিত না হয়। বহিরাগত হিসাবে মুসলিমরা এসব বিধিনিষেধ অনুসরণে বাধ্য ছিল না, এবং তাদের পেছনে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমাজের শক্তি ছিল। মুসলিমরা ভারতে সংখ্যালঘু রয়ে যায়। নিম্নবর্ণের কিছু হিন্দু, অস্পৃশ্যদের একটা অংশসহ, মূলত সুফি পিরদের প্রচারণার ফলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের হিন্দু, বুদ্ধ এবং জৈন আনুগত্য বজায় রাখে। একথা ঠিক নয় যে, যেমনটি জোরের সঙ্গে বলা হয়ে থাকে, মুসলিমরা ভারতে বুদ্ধধর্ম ধ্বংস করেছে। মাত্র একটা মঠে আক্রমণের একমাত্র প্রমাণ আছে, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের সমর্থনসূচক কোনও অকাট্য দলিল বা তথ্য নেই। ১৩৩০ নাগাদ উপমহাদেশের বৃহত্তর অংশ দিল্লীর সালতানাতের কর্তৃত্ব মেনে নেয়, কিন্তু সুলতানদের পক্ষের অবিবেচক সরকার মুসলিম আমিরদের মাঝে বিদ্রোহ জাগিয়ে দেয় এবং এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে একজন ব্যক্তির শাসনের পক্ষে সালতানাতের আকার অনেক বড়। স্বাভাবিকভাবেই, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ভেঙে পড়ে এবং আমিরগণ উলেমাদের সাহায্যে যাঁর যাঁর রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। গানপাউডার আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত দিল্লীর সালতানাত মুসলিম ভারতের অনেক শক্তির মাঝে অন্যতম ছিল।
মঙ্গোল রাজ্যসমূহের প্রান্তবর্তী এলাকায় গাজী যোদ্ধাদের তাদের নিজস্ব আমিরাত পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল, মঙ্গোল শাসকদের অধিরাজ বলে স্বীকার করে নিয়েছিল তারা। গাজীরা সাধারণভাবে ধার্মিক এবং সুফিবাদের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে ছিল। আযেরবাইজান ও আনাতোলিয়ায় বিভিন্ন তরিকাহ্ গড়ে উঠেছিল যেগুলো সুফিবাদের কোনও কোনও চরমপন্থী ধরনের সঙ্গে প্রাচীন বিপ্লবাত্মক শিয়া বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটিয়েছিল। তারা “চরমপন্থী” ঘুলুউ (ghuliw) ধর্মতত্ত্বের পুনর্জাগরণ ঘটায় যা প্রাথমিক যুগের শিয়াদের অনুপ্রাণিত করেছিল, এই মত অনুযায়ী আলীকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়, এরা বিশ্বাস করত যে, পরলোকগত আমিরগণ “ঊর্ধ্বগামী” (Occultation) হয়েছেন এবং প্রায়শ: নেতাদের মাহুদি হিসাবে শ্রদ্ধা জানাত, যিনি ন্যায়-বিচারের নবযুগের সূচনা ঘটাতে ফিরে এসেছেন। আনাতোলিয়ার বক্তাশি দরবেশদের (Bekhtashe dervishes) ব্যাপক অনুসারী ছিল; তারা অত্যাসন্ন নতুন ব্যবস্থার কথা বলত যা প্রাচীন ধর্মীয় নিয়মকানুন ঝেড়ে বিদায় করবে। আযেরবাইজানের সাফাভিয়াহ্ ব্যবস্থাও একই রকম গোঁড়া বিশ্বাসের অনুসারী ছিল। সুন্নী তরিকাহ্ হিসাবে সূচিত হলেও পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ তা ঘুলুউ ধ্যানধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়, এই মতাবলম্বীরা নিজেদের দ্বাদশবাদী শিয়া বলে আখ্যায়িত করত। নেতাকে তারা সপ্তম ইমামের বংশধর হিসাবে বিশ্বাস করত; সেকারণে তিনিই মুসলিম উম্মাহর একমাত্র বৈধ নেতা। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই মতবাদের পির ইসমায়েল, যিনি হয়ত নিজেকে গুপ্ত ইমামের অবতার বলে বিশ্বাস করতেন, ইরানে এক শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
মঙ্গোল রাজ্যসমূহের পতন ঘটলে, সমগ্র আনাতোলিয়া ছোট ছোট স্বাধীন গাজী রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়, যেগুলো আবার ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষপর্যায় থেকে পতনশীল বাইযানটাইন সাম্রাজ্যের শহর আর গ্রামাঞ্চল ছিনিয়ে নিতে শুরু করে। এই রাজ্যগুলোর অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য শাসিত হচ্ছিল ওসমানলি পরিবারের হাতে; যা চতুদর্শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৩২৬-এ ওসমানলি বা অটোমানরা বাসরাহ্ দখল করে নেয়, যা তাদের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৩২৯-এ তারা ইযনিক ছিনিয়ে নেয় এবং ১৩৭২ নাগাদ বাইযানটিয়ামের বৃহত্তর এলাকা দখল করে। এডিরনে (অ্যাড্রিয়ানোপল) এক নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে তারা এবং বাইযানটাইন সম্রাটকে নির্ভরশীল মিত্রে পরিণত করে। অটোমানদের সাফল্যের রহস্য ছিল তাদের প্রশিক্ষিত পদাতিক বাহিনীর শৃঙ্খলা; এ বাহিনী “নয়া বাহিনী” (veni-cheri বা Janissary) নামে পরিচিত এক দাসবাহিনী 1 প্রথম মুরাদ (১৩৬০-৮৯) সবচেয়ে শক্তিশালী পশ্চিমা মুসলিম শাসকে পরিণত হন। ১৩৭২-এ বলকান এলাকায় অগ্রসর হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান তিনি, বলকান পেনিনসূলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি স্বাধীন বুলগার এবং সারবিয়া রাজ্যে আক্রমণ চালান। ১৩৮৯তে অটোমানরা মধ্য সার্বিয়ায় কসোভো যুদ্ধক্ষেত্রে সার্বীয় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে। মুরাদ নিহত হন, কিন্তু সারবীয় যুবরাজ হেলবেলিয়ানোভিচ লাযার (Hrevlbeljanovic Lazar) কে বন্দী ও পরে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে সারবিয়ার স্বাধীনতার এবং আজও সাবরিয়রা যুবরাজ লাযারকে একজন শহীদ এবং জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়ে থাকে; ইসলামের প্রতি গভীর ঘৃণা পোষণ করে তারা। কিন্তু অটোমানদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে এবং তা কোনওভাবেই বাইযানটাইন প্রজাসাধারণের সিংহভাগের কাছে অজনপ্রিয় ছিল না। বিশৃঙ্খল অবস্থায় নিপতিত ছিল পুরানো সাম্রাজ্য; অটোমানরা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে, চাঙা করে তোলে অর্থনীতি; আর জনগণের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ১৪০২তে অ্যাঙরায় টিমুর তাদের সেনাদলকে পরাজিত করলে অটোমানরা প্রথম বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল, কিন্তু টিমুরের মৃত্যুর পর তারা আবার শক্তি সংহত করতে সক্ষম হয়; এবং ১৪৫৩তে দ্বিতীয় মেহমেদ (১৪৫১-৮১) খোদ কনসট্যান্টিনোপলই অধিকার করে নিতে সক্ষম হন– নতুন গানপাউডার অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে।