পরিবর্তন উত্তেজনাকর হতে পারে, আবার বিব্রতকরও। টিউনিসে আব্দ আল- রাহমান ইবন খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) ইসলামী জগতের পশ্চিম প্রান্ত, মাগরিবে একের পর এক রাজবংশের পতন প্রত্যক্ষ করেছেন। প্লেগ মহামারিতে ধ্বংস হয়ে গেছে অসংখ্য জনবসতি। যাযাবর গোত্রগুলো মিশর থেকে উত্তর আফ্রিকায় এসে ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেই সঙ্গে যোগ হয় ঐতিহ্যবাহী বারবার (Berbar) সমাজের নিম্নমুখী যাত্রা। ইবন খালদুন স্বয়ং টিউনিসিয়ায় এসেছিলেন স্পেন থেকে, যেখানে ক্রিশ্চানরা মুসলিম এলাকায় এক সফল রিকনকুইস্টা (reconquista) পরিচালনা করে ১২৩৬-এ কর্ডোভা এবং ১২৪৮-এ সেভিল দখল করে নিয়েছিল। সমৃদ্ধ মুসলিম রাজ্য আল-আন্দালুসের বাকি রয়ে গিয়েছিল কেবল নগর-রাজ্য গ্রানাডা, যা ১৪৯২তে ক্রিশ্চানদের কাছে পরাস্ত হয়, কিন্তু তার আগেই চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অনন্যসাধারণ আলহাম্বরা প্রাসাদ নির্মিত হয়ে গিয়েছিল। স্পষ্টতই সঙ্কটে নিপতিত ছিল ইসলাম। “যখন পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে,” বলেছেন ইবন খালদুন, “সেটা যেন গোটা সৃষ্টি বদলে যাওয়া, বদলে যাওয়া গোটা বিশ্বেরই, যেন নতুন করে সৃষ্টি ঘটছে, এক পুনর্জন্ম, নতুন করে অস্তিত্ব পেয়েছে জগৎ।”
ইবন খালদুন এই পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত: তিনি ছিলেন সর্বশেষ প্রধান স্প্যানিশ ফায়লাসুফ; তাঁর অসাধারণ উদ্ভাবন ছিল ইতিহাসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে দার্শনিক যুক্তিবাদের নীতিমালার প্রয়োগ, এর আগে পর্যন্ত যা দার্শনিকদের মনোযোগের বাইরে ছিল বলে মনে করা হয়, কেননা এটা চিরন্তন সত্যের পরিবর্তে কেবল অস্থায়ী, অনিশ্চিত ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ইবন খালদুন বিশ্বাস করতেন যে, ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে বিশ্বজনীন আইন সমাজের ভাগ্যকে পরিচালিত করে। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে দলীয় সংহতির (আসিবীয়াহ্-asibiyyah) প্রবল বোধই কোনও জাতিকে টিকে থাকতে সক্ষম করে তোলে এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে অন্য জাতিকে বশীভূত করা যায়। এই অধিকার বোঝায় যে প্রভাবশালী দলটি অধীনের লোকদের সম্পদ আত্মীকরণ করে সংস্কৃতি আর জটিল নাগরিক জীবন গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু শাসকশ্রেণী যখন বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, আত্মপ্রসাদ জাঁকিয়ে বসে তখন এবং তারা তাদের প্রাণশক্তি হারাতে শুরু করে। তারা আর তখন প্রজাদের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না, নিজেদের মাঝে ঈর্ষা আর কোন্দল শুরু হয়ে যায়; অর্থনীতি নিম্নগামী হতে শুরু করে। এভাবে রাষ্ট্রটি এক নয়া গোত্রীয় বা যাযাবর বাহিনীর কাছে, যারা তাদের নিজস্ব আসিবীয়ার প্রথম পর্যায়ে, নাজুক হয়ে পড়ে এবং আবার চক্রটির সূচনা ঘটে। ইবন খালদুনের প্রধান রচনা আল- মাকাদ্দিমাহ্: অ্যান ইনট্রোডাকশন টু হিস্ট্রি’ ইসলামের ইতিহাসে এই তত্ত্বের প্রয়োগ দেখিয়েছে, যা পরবর্তী বছরগুলোয় মুসলিম সাম্রাজ্য নির্মাণকারীগণ ও উনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ নিবিষ্ট মনে পাঠ করেছেন। ইবন খালদুনকে ইতিহাসের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখেছেন এঁরা চতুদর্শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মঙ্গোল রাজ্যগুলোর পতন প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন ইবন খালদুন, যা তাঁর তত্ত্বকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। তাদের আদি আসিবীয়াহ্ চরমে পৌঁছেছিল, আত্মপ্রসাদ জাঁকিয়ে বসেছিল, এবং মঞ্চ তৈরি হয়ে গিয়েছিল অন্য প্রভাবশালী দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার। এটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল যে নতুন নেতাদের আগমন ঘটবে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র থেকে নয় বরং মুসলিম বিশ্বের প্রান্তবর্তী এলাকা থেকে, যা মঙ্গোল শাসনাধীন ছিল না। ইতিমধ্যে মিশর ও সিরিয়ায় মামলুক সাম্রাজ্যেরও পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তুঙ্গ সময়ে মামলুকরা শক্তিশালী esprit de corps এর এক বিকাশমান সংস্কৃতিক প্রাণবন্ত সমাজ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ যেকোনও কৃষিভিত্তিক রাজ্যের মত সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ায় সাম্রাজ্যটি ধসে পড়তে শুরু করে।
সময়ের চেতনা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করেছিলেন যে শাসক, তিনি সির (Syr) উপত্যকাবাসী এক তুর্কি, সমরকন্দে মঙ্গোল চ্যাঘাতাই রাজ্যে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি এবং মঙ্গোল আদর্শের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল ছিলেন। টিমুর (১৩৩৬-১৪০৫), যিনি টিমুর ল্যাঙ্ক (খোঁড়া টিমুর) নামে পরিচিত, কারণ স্পষ্ট খুঁড়িয়ে চলতেন তিনি, পাশ্চাত্য যার পরিচয় টাম্বুর লেইন, পতনোম্মুখ চ্যাঘাটাই সাম্রাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নিজেকে মঙ্গোল বংশোদ্ভূত দাবী করেন এবং অতীতের হামলাগুলোর মতই একই রকম বর্বরতায় পুরনো মঙ্গোল এলাকা পুনর্দখলে নামেন। টিমুর তাঁর সাফল্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর ধ্বংসলীলার প্রতি আকর্ষণকে ইসলামের প্রতি আবেগের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছিলেন, আর যেহেতু তিনি তাঁর সময়ের চেতনাকে নিখুঁতভাবে ধারণ করেছেন, একজন লোকনায়কে পরিণত হন তিনি। সমরকন্দে দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে জাঁকজমকপূর্ণ দরবারে বসতেন। তাঁর ইসলামের- গোঁড়ামিপূর্ণ, নিষ্ঠুর এবং সহিংস –সঙ্গে উলেমাদের রক্ষণশীল ধার্মিকতা বা সুফিদের ভালোবাসার মতবাদের সামান্যই মিল ছিল। নিজেকে আল্লাহ্র শাস্তিদূত হিসাবে দেখেছেন তিনি, মুসলিম আমিরদের অন্যায় আচার অনুষ্ঠানের কারণে শাস্তি দিতে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং দুষ্টের দমন; যদিও প্রজারা টিমুরের নিষ্ঠুরতাকে ভয় পেত, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোর বিচ্ছিন্নতার পর তাঁর শক্তিশালী সরকারের গুণও গেয়েছে। পূর্বসূরী মঙ্গোলদের মত টিমুরকেও অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছিল এবং একসময় ধারণা জন্মেছিল যে তিনি বিশ্ব জয় করতে যাচ্ছেন। ১৩৮৭ নাগাদ গোটা ইরানি উঁচু অঞ্চল এবং মেসোপটেমিয়ার সমভূমি অধিকার করে নেন তিনি। ১৩৯৫তে রাশিয়ায় গোল্ডেন হোর্ড দখল করেন এবং ১৩৯৮তে চড়াও হন ভারতের ওপর, এখানে হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করেন, ধ্বংস করে দেন দিল্লী। এর দু’বছর পর আনাতোলিয়া জয় করেন তিনি, দামাস্কাসকে কুক্ষিগত করেন এবং এক হত্যাযজ্ঞ চালান বাগদাদে। অবশেষে ১৪০৪-এ চীনের দিকে অগ্রসর হন তিনি, পরের বছর নিহত হন সেখানে।