অন্যরা এসময়ের উত্থান-পতনে ভিন্নভাবে সাড়া প্রদান করেছিল। আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ, যখন অনেক কিছুই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল, এক ধরনের রক্ষণশীলতার জন্ম দিয়েছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজের যা চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। সীমিত সম্পদ যখন থাকে তখন, আধুনিক পাশ্চাত্যে যেমন পারি আমরা, তেমনিভাবে আবিষ্কার বা মৌলিক উদ্ভাবনে উৎসাহ জোগানো সম্ভব হয় না। পাশ্চাত্যে আমরা আমাদের পিতা-মাতার প্রজন্মের চেয়ে আরও বেশী জানতে চাই এবং আমাদের সন্তানরা আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ ভোগ করবে বলে আশা করি। আমাদের পূর্ববর্তী কোনও সমাজের এভাবে বর্তমান কালের উদ্ভাবনের দাবী অনুযায়ী কর্মীদের লাগাতারভাবে পুন:প্রশিক্ষণ আর অবকাঠামোর পরিবর্তন আনার সাধ্য ছিল না। পরিণামস্বরূপ, প্রাক-আধুনিক সকল সমাজে, কৃষিভিত্তিক ইউরোপসহ, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকে টিকিয়ে রাখা এবং ব্যক্তিবিশেষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কৌতূহলে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করা, যেন সমাজ বা গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না হয়। কেননা, ওই সামজের নবনব ধারণার সংহতি ও প্রয়োগ করার কোনও উপায় ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, মাদ্রাসাসমূহে ছাত্ররা প্রাচীন বিবরণ ও টীকাভাষ্য মন দিয়ে মুখস্থ করেছে এবং শিক্ষার উপাদান ছিল একটি মান-গ্রন্থের শাব্দিক ব্যাখ্যা। পণ্ডিতদের মধ্যে প্রকাশ্য বিতর্কের ক্ষেত্রে ধরেই নেয়া হত যে বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের একজন সঠিক ও অন্যজন অসঠিক। প্রশ্নোত্তরমূলক ধরনের পাঠে বিপরীতমুখী দুটি পক্ষের মাঝে বিরোধের ভেতর দিয়ে কোনও নতুন সিন্থেসিস বের করে আনার ভাবনা ছিল না। এভাবে মাদ্রাসাসমূহ সেইসব ধ্যান- ধারণার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়াস পেয়েছে যেগুলোর সাহায্যে সারা বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করা যাবে এবং ধর্ম বিরোধী ধ্যান ধারণাকে চাপা দেয়া যাবে, যেন বিরোধ সৃষ্টির ফলে মানুষ সরল পথ ত্যাগ করে আপন পথ বেছে না নেয়।
চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ একমাত্র শরিয়া পাঠ ও পালনই সুন্নী, শিয়া, সুফি এবং ফায়লাসুফ- অর্থাৎ সকল মুসলিমের গৃহীত ধার্মিকতার রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সময়ের উলেমারা বিশ্বাস করতে থাকেন যে ইসলামী ইতিহাসের একেবারে সূচনাকাল থেকেই এসব আইনের অস্তিত্ব রয়েছে। এভাবে রুমির মত কিছু সুফি যখন নতুন দিগন্তের দিকে তাকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, উলেমাদের অনেকেই তখন বিশ্বাস করছিলেন যে কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। এ কারণে “ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ হওয়ায় সন্তুষ্ট ছিলেন তাঁরা। অতীতের শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতি, পাণ্ডুলিপির বিনাশ এবং জ্ঞানী-গুণীদের নির্বিচারে হত্যার পর সম্পদের পুনরুদ্ধারই নতুন কোনও পরিবর্তন আনার চেয়ে ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মঙ্গোল সামরিক আইনে সাধারণ নাগরিকদের বিষয়ে কোনও বিধিব্যবস্থা না থাকায় উলেমারা বিশ্বাসীদের জীবনধরন পরিচালনা অব্যাহত রাখেন এবং তাঁদের প্রভাব রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত হয়। রুমির মত সুফিরা যেখানে সকল ধর্মকেই বৈধ বলে বিশ্বাস করেছেন, চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ উলেমাগণ সেখানে কুরানের বহুত্ব মতবাদকে কঠিন সাম্প্রদায়িকতায় রূপ দিয়েছেন, যেখানে অন্য ট্র্যাডিশনসমূহকে অতীতের মূল্যহীন নজীর হিসাবে দেখা হয়। অমুসলিমদের জন্যে এই সময় পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনা সফর নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আর পয়গম্বর মুহাম্মদ(স:) সম্পর্কে কোনও আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ পরিণত হয় মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই, আগ্রাসনের যাতনা মুসলিমদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগিয়েছিল। ভিনদেশীরা কেবল সন্দেহভাজনই নয়, তারা মঙ্গোলদের মতই ভয়ঙ্কর হতে পারে।
কিন্তু “ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী উলেমাগণও ছিলেন। সমগ্র ইসলামী ইতিহাস জুড়ে, রাজনৈতিক সংকটের সময়–বিশেষ করে বিদেশী দখলদারিত্বের সময়- একজন সংস্কারক (মুজদাদিদ) প্রায়শ বিশ্বাসের জাগরণ ঘটান যাতে তা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। এইসব সংস্কারক সাধারণত একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে থাকেন। এগুলো রক্ষণশীল, কেননা একেবারে নতুন সমাধান সৃষ্টির বদলে তা মূলে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পায়। কিন্তু কুরান ও সুন্নাহর আদি ইসলামে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা থেকে সংস্কারকারকগণ প্রায়শই পবিত্র বলে বিবেচিত পরবর্তী মধ্যযুগীয় সকল পরিবর্তনকে প্রতিমা পূজার বিরোধিতার মত বিতাড়ন করতে চান। এঁরা বিদেশী প্রভাবের বেলায়ও সন্দিহান হন এবং ভিনদেশী সংযোগও– যা তাঁদের দৃষ্টিতে ধর্মবিশ্বাসের খাঁটিত্বকে বিনষ্ট করে। এধরনের সংস্কারকগণ মুসলিম সমাজের একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছেন। আমাদের বর্তমান সময়ে যাদের “মুসলিম মৌলবাদী” বলে আখ্যায়িত করা হয়, তাদের অনেকেই মুজদাদিদদের রেখে যাওয়া পুরনো প্যাটার্নই হুবহু বেছে নিয়েছে।
মঙ্গোল পরবর্তীকালের পৃথিবীর যুগ-শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন আহমাদ ইবন তাঈমিয়াহ্ (১২৬৩-১৩২৮)। দামাস্কাসের আলিম ছিলেন তিনি, মঙ্গোলদের চরম ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছিল নগরীটি। হানবালি মাযহাবের অনুসারী এক প্রাচীন উলেমা পরিবারে ইবন তাঈমিয়ার জন্ম, শরিয়া মূল্যবোধ সুসংহত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি ঘোষণা করেন যে, যদিও মঙ্গোলরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু আসলে তারা অপশক্তি এবং ধর্মত্যাগী, কেননা তারা শরিয়াহ্র পরিবর্তে ইয়াসা জারি করেছে। একজন প্রকৃত সংস্কারকের মতই পয়গম্বর ও রাশিদুন পরবর্তী যুগে ইসলামের বিকাশকে –যেমন শিয়াবাদ, সুফিবাদ এবং ফালসাফাহ্- মেকি হিসাবে আক্রমণ করেছেন তিনি,। তবে তাঁর একটা ইতিবাচক কর্মসূচীও ছিল। পরিবর্তিত এই সময়ে মুসলিমদের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ করার স্বার্থে শরিয়াহ্কে সময়োপযোগী করতে হবে, সেজন্যে যদি কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা ফিক্হ’র বেশীরভাগ বিসর্জনও দিতে হয়। সুতরাং শরিয়ার চেতনামুখী বৈধ সমাধান আবিষ্কারের লক্ষ্যে জুরিস্টদের জন্যে ইজতিহাদের প্রয়োগ আবশ্যক, যদি তাতে সাম্প্রতিককালে যেভাবে আইনের ভাষ্য নেয়া হচ্ছে তার লঙ্ঘনও ঘটে। প্রশাসনের জন্যে উদ্বেগজনক ব্যক্তি ছিলেন ইবন তাঈমিয়াহ্। কুরান ও সুন্নাহ’য় তাঁর প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামের সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের বেশীরভাগেরই প্রত্যাখ্যান হয়ত প্রতিক্রিয়াশীলতা ছিল, কিন্তু আবার বিপ্লবীও। রক্ষণশীল উলেমাদের খেপিয়ে তুলেছিলেন তিনি, যাঁরা গ্রন্থভুক্ত জবাব আঁকড়ে ছিলেন; সিরিয়ার মামলুক সরকারেরও সমালোচনা করেছেন তিনি, তাঁর দৃষ্টিতে ইসলামী আইনবিরোধী আচার অনুষ্ঠান অনুসরণ করার কারণে। ইবন তাঈমিয়াহকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং বলা হয় যে মনের দুঃখে মারা গেছেন তিনি, কারণ আটককারীরা তাঁকে লেখালেখির অনুমতি দেয়নি। কিন্তু দামাস্কাসের সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল, কেননা তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাঁর শরিয়ার সংস্কার উদারপন্থী ছিল এবং তিনি মনেপ্রাণে তাদের প্রয়োজনের কথা ভেবেছেন। তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানটি গণস্বীকৃতির এক বিশাল প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছিল।