ইসলামের সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে এমন ব্যাপক পার্থক্য আর কিছু হতে পারে না; কিন্তু এক অর্থে এটা ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের শেষ পর্যায়ে সংঘটিত সমাজ ব্যবস্থার সামরিকীকরণেরই ধারাবাহিকতা, যেখানে আমিরগণ গ্যারিসনে অবস্থান করে শাসন কাজ চালাতেন আর সাধারণ মানুষ ও উলেমাগণ চলতেন তাদের নিজস্ব ইসলামী ব্যবস্থায়। কোনও আমির স্থিতিশীলতার অনুরূপ কিছু অর্জনে সক্ষম হলে নাগরিক জীবনে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রবল সম্ভাবনা সবসময়ই রয়ে যেত। মঙ্গোল শাসকদের অধীনে একটা পর্যায় পর্যন্ত এমনটি ঘটেছে, যারা উলেমাদের ওপর নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপের মত যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। শরিয়াহকে আর সম্ভাব্য রাজদ্রোহী আইন থাকতে দেয়া হয়নি। পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে উলেমাগণ আর নিজস্ব স্বাধীন বিবেচনা বোধ (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করে আইন নির্মাণ করতে পারবেন না; বলা হয় যে “ইজতিহাদের দ্বার” বন্ধ হয়ে গেছে। মুসলিমরা অতীতের কর্তৃপক্ষের বিধিবিধান মেনে নিতে বাধ্য হল। নীতিগতভাবে শরিয়াহ্ প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের একটা ব্যবস্থায় পরিণত হল, যা শাসক পরিবারের অধিকতর গতিশীল বংশগত আইনকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারবে না।
মুসলিম জীবনে মঙ্গোল হস্তক্ষেপ ছিল বেদনাদায়ক। মঙ্গোলরা তাদের পেছনে ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী আর লাইব্রেরির ভস্মস্তূপ রেখে গিয়েছিল, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক পঙ্গুভাব। কিন্তু বিজয় অর্জন করার পর মঙ্গোলরা ধ্বংস করা নগরীগুলোকে চোখ ধাঁধানো রূপে পুনর্নির্মাণ করে। জাঁকাল দরবারও প্রতিষ্ঠা করে তারা যেখানে বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ইতিহাস আর অতীন্দ্রিয়বাদ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। মঙ্গোলদের ধ্বংস ভয়াবহ হলেও, মঙ্গোল শাসকরা মুসলিম প্রজাদের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক কাঠামোগুলো নীরব স্থায়ীত্ব পেয়েছে এবং আমরা লক্ষ্য করব, পরবর্তীকালের মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। মঙ্গোলদের ক্ষমতা নতুন দিগন্তের আভাস দিয়েছিল। তারা যেন গোটা বিশ্ব জয় করবে বলে মনে হয়েছিল। এক নতুন ধরনের সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ ছিল তারা যা প্রবল ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে যোগ করেছিল বিশ্ব শাসনের সম্ভাবনা। তাদের সাম্রাজ্যের জাঁকজমকে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। তারা মুসলিমদের পূর্ব-ধারণাকে বিনষ্ট করলেও মুসলিমরা কিন্তু তাদের প্রত্যক্ষ করা হিংস্রতায় নিষ্ক্রিয় হয়ে হয়ে পড়েনি, কিংবা এইসব মঙ্গোলরাজ্যগুলোর তুলে ধরা রাজনৈতিক পরাজয় হতদ্যোম করেনি তাদের। ইসলাম একটি স্থিতিস্থাপক ধর্ম। মুসলিমরা তাদের ইতিহাসে বারবার বিপর্যয়ের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং নতুন ধর্মীয় দর্শন (insight) পাবার লক্ষ্যে গঠনমূলকভাবে একে ব্যবহার করেছে। তো মঙ্গোল-আগ্রাসনের পরেও তাই ঘটেছে; মানুষ তখন অনুভব করল যে তাদের চেনা জগতের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু আবার একেবারে নতুন এক বৈশ্বিক ব্যবস্থাও সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
সুফি অতীন্দ্রিয়বাদী জালাল আল-দিন রুমির (১২০৭-৭৩) দর্শনে এ ব্যাপারটা পরিষ্কার ধরা পড়েছে। নিজে মঙ্গোলদের শিকার ছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁর শিক্ষা মঙ্গোলদের বয়ে আনা সীমাহীন সম্ভাবনার বোধটিকেই তুলে ধরে। রুমির জন্ম হয়েছিল খুরাসানে, তাঁর পিতা ছিলেন একজন আলিম এবং সুফিগুরু। রুমি স্বয়ং ফিক্হ, থিয়োলজি, আরবী এবং পারসিয়ান সাহিত্যে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু অগ্রসরমান মঙ্গোল অশ্বারোহীবাহিনীর কবল থেকে রক্ষা পেতে তাঁর পরিবার পালাতে বাধ্য হয়। তাঁরা আনাতোলিয়ায় রাম সালতানাতের রাজধানী কোনিয়ায় শরণার্থী হিসাবে আসেন। রুমির আধ্যাত্মিকতা সৃষ্টির গৃহহীনতা আর ঐশী উৎস ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিতে পরিপূর্ণ। মানুষের উপর নেমে আসা সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ভাগ্য হল, জোর দিয়ে বলেছেন রুমি, বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা অনুভব না করা, যা নারী বা পুরুষকে ধর্মীয় অনুসন্ধানে তাড়িত করে। আমাদের অবশ্যই নিজের অসম্পূর্ণতা উপলব্ধি করতে হবে, বুঝতে হবে যে আমাদের আত্মবোধ এক মায়া। আমাদের অহম বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখে এবং অহমবোধ ও স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দেয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আবিষ্কার করব যে একমাত্র ঈশ্বরই অস্তিত্ববান।
রুমি ছিলেন “মাতাল সুফি” (Drunken Sufi)। তাঁর আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিজীবন বিভিন্ন চরম আবেগের পর্যায় স্পর্শ করেছে; নৃত্য, সঙ্গীত, কবিতা এবং গানে পরমানন্দের (ecstacy) অনুসন্ধান করেছেন তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সদস্যদের প্রায়ই তাদের অনন্য ঘূর্ণি-নৃত্যের কারণে “ঘূর্ণায়মান দরবেশ” (Whirling Dervishes) বলে অভিহিত করা হয়; এই নাচ অতিলৌকিকের এক ঘোরলাগা অবস্থার সৃষ্টি করে। রুমি তাঁর স্পষ্ট অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও জীবৎকালে অনুসারীদের কাছে মাওলানাহ্ (আমাদের প্রভু) হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং আজও টার্কিতে তাঁর মাওলানাহ্ ব্যবস্থার বিপুল প্রভাব রয়েছে। তাঁর প্রধান রচনা মাসনাবি (Mathnawi) সুফি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত। ইবন আল-আরাবি যেখানে মননশীলদের জন্যে লেখালেখি করেছেন রুমি সেখানে সমগ্র মানব জাতিকে নিজেদের ঊর্ধ্বে ওঠার আহবান জানিয়েছেন, দৈনন্দিন জীবনের নৈমিত্তিকতাকে ছাড়িয়ে যেতে বলেছেন। মাসনাবি সুফি জীবনধারাকে বিধি-সম্মত করে তোলে যা যে-কাউকে স্বর্গলোক এবং আত্মার মাঝে চিরন্তন যুদ্ধে অপরাজেয় বীরে রূপান্তরিত করতে পারে। মঙ্গোল আগ্রাসনসমূহ এক অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল, জনগণকে তাদের মনের গভীরে অনুভূত বিপর্যয় সামলে ওঠার শক্তি জুগিয়েছে তা এবং রুমি ছিলেন এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শ। এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত নতুন সুফি তরিকাসমূহ মানবজীবনের সীমাহীন সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়েছে। মঙ্গোলরা জাগতিক রাজনীতিতে যা অর্জন করেছিল সুফিগণ সেটাই আধ্যাত্মিক পর্যায়ে অনুভব করতে পারে।