খলিফাহ্ আল-নাসির (১১৮০-১২২৫) বাগদাদ এবং এর আশপাশে খেলাফত পূন:প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছিলেন। ধর্মীয় পুনর্জাগরণের শক্তি উপলব্ধি করে ইসলামের আশ্রয় নেন তিনি। আদিতে খেলাফত শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ শরিয়ার আবির্ভাব ঘটেছিল, কিন্তু আল-নাসির আলিম হওয়ার লক্ষ্যে এবার চারটি সুন্নী মতবাদ নিয়েই পড়াশোনায় লিপ্ত হলেন। এক ফুতুওয়াহ্ সংগঠনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি, উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে বাগদাদের সকল ফুতুওয়াত্র মহাগুরু (Grand Master) হিসাবে গড়ে তোলা। আল-নাসিরের পরলোকগমনের পর তাঁর উত্তরাধিকারীগণ এই নীতিমালা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। অচিরেই ইসলামী জগৎ এক মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়ে, যা শেষ পর্যন্ত আব্বাসীয় খেলাফতের সহিংস ও করুণ পরিসমাপ্তি ডেকে এনেছিল।
মঙ্গোল (১২২০-১৫০০ )
দূরপ্রাচ্যে মঙ্গোল গোত্র অধিপতি জেংঘিস খান এক বিশ্ব-সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিলেন, ইসলামী জগতের সঙ্গে তাঁর সংঘাত ছিল অনিবার্য। সেলজুকদের বিপরীতে তিনি তাঁর যাযাবর বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তাদের এমন এক যুদ্ধবাজ যন্ত্রে পরিণত করেন যে তাদের মত ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার অধিকারী বাহিনী বিশ্ব এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। কোনও শাসক যদি অবিলম্বে এই মঙ্গোল গোত্রপতির কাছে নতি স্বীকার না করতেন, অনায়াসে ধরে নেয়া যেত যে তাঁর রাজ্যের প্রধান প্রধান নগর ভূমিস্মাৎ হয়ে গেছে, হত্যাযজ্ঞে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অধিবাসীরা। মঙ্গোলদের হিংস্রতা পরিকল্পিত কৌশল ছিল বটে; কিন্তু তা নাগরিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যাযাবর গোষ্ঠীর তীব্র অসন্তোষেরও পরিচায়ক। খয়ারাযমিয়ান তুর্কিদের শাহ্ মুহাম্মদ (১২০০-১২২০) যখন ইরান এবং ওক্সাস অঞ্চলে নিজস্ব মুসলিম খেলাফত গড়ে তোলার প্রয়াস পান, মঙ্গোল সেনাপতি হুলেগু (Hulegu) বেপরোয়া ঔদ্ধত্য বলে ধরে নেন একে। ১২১৯ থেকে ১২২৯ পর্যন্ত মঙ্গোলরা মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্র জালাল আল-দিনকে গোটা ইরান থেকে আযেরবাইজান হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত মৃত্যু আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালিয়ে ধাওয়া করে বেরিয়েছে। ১২৩১-এ নতুন করে আবার উপর্যুপরি হামলার সূচনা ঘটে। একের পর এক মুসলিম নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ধূলিসাৎ হয়ে যায় বুখারা, একমাত্র যুদ্ধে পতন ঘটে বগদাদের, সেই সঙ্গে অবসান ঘটে মৃত্যুপথযাত্রী খেলাফতের: পথে পথে লাশের স্তূপ পড়েছিল, শরণার্থীরা পালিয়ে গিয়েছিল সিরিয়া, ইরাক আর ভারতে। আলামুতের ইসমায়েলিদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় এবং যদিও রামে সেলজুকদের নতুন রাজবংশ দ্রুত মঙ্গোলদের কাছে নতি স্বীকার করেছিল, কিন্তু তা আর কখনওই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রথম যে মুসলিম শাসক মঙ্গোলদের ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হন তিনি হলেন তুর্কি দাস বাহিনী শাসিত নতুন মিশরীয় রাষ্ট্রের সুলতান বায়বরস। মামলুকরা (দাস) সালাদিন প্রবর্তিত আইয়ুবীয় সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল; ১২৫০-এ মামলুক আমিরগণ আইয়ুবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে নিকট প্রাচ্যে নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৬০-এ উত্তর প্যালেস্টাইনের আইন জালুটে বায়বরস মঙ্গোল সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ভারতে পরিচালিত আক্রমণ দিল্লীর নয়া সালতানাত ঠেকিয়ে দেয়ার পর মঙ্গোলরা বিজয়ের ফল ভোগ করার উদ্দেশ্যে স্থির হয়, চীনে অবস্থানরত মঙ্গোল খান কুবলাইয়ের অনুগত ইসলামী জগতের কেন্দ্রভূমিতে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তারা।
মঙ্গোলরা চারটি বৃহদাকার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ছিল। ইল-খানস্ নামে পরিচিত (মহাশক্তিধর খানের প্রতিনিধি) হুলেগুর বংশধররা প্রথমে তাদের পরাজয়কে চূড়ান্ত বলে মানতে চাননি, দামাস্কাস ধ্বংস করার পর অবশেষে ক্ষান্ত হন তাঁরা এবং টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকা আর ইরানের পার্বত্য অঞ্চলে আপন সাম্রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। চ্যাঘাতাই মঙ্গোলরা সির-ওক্সাস বেসিনে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, অন্যদিকে হোয়াইট হোর্ডরা (White Horde) আরটিশ (Irtish) এলাকায় আর গোল্ডেন হোর্ডরা (Golden Horde) ভলগা নদীর আশেপাশে বসতি গড়ে। সপ্তম শতাব্দীর আরবীয় আগ্রাসনের পর এটাই ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন; কিন্তু আরব মুসলিমদের বিপরীতে মঙ্গোলরা সঙ্গে করে কোনও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আসেনি। অবশ্য তারা সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিল, যদিও ঝোঁক ছিল বুদ্ধ মতবাদের দিকে। তাদের আইন কাঠামো, ইয়াসা (Yasa) যা স্বয়ং জেংঘিস খানের অবদান, ছিল একেবারেই সামরিক ব্যবস্থা, যা সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করেনি। মঙ্গোলদের নীতি ছিল কোনও এলাকা কুক্ষিগত করার পর সেখানকার স্থানীয় ট্র্যাডিশনের অনুযায়ী অগ্রসর হওয়া, ফলে এয়োদশ শতাব্দীর শেষ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরু নাগাদ চারটি মঙ্গোল সাম্রাজ্যই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
তো মঙ্গোলরা কেন্দ্রীয় ইসলামী মূল এলাকার প্রধান মুসলিম শক্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের প্রতি আনুগত্য যাই হোক না কেন তাদের রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শ ছিল “মঙ্গোলিজম” যা মঙ্গোলদের সাম্রাজ্যবাদী এবং সামরিক শক্তিকে মহিমান্বিত করেছে আর বিশ্ব বিজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে। গোটা রাজ্য সামরিক কায়দায় পরিচালিত হত। সম্রাট ছিলেন সর্বাধিনায়ক এবং তিনি স্বয়ং সেনাদলের নেতৃত্ব দেবেন বলে প্রত্যাশিত ছিল, অভিযানের দায়িত্ব সহকারীদের ওপর ছেড়ে দেবেন না। এই কারণে গোড়ার দিকে কোনও রাজধানী ছিল না। খান এবং তাঁর সেনাবাহিনী যখন যেখানে শিবির স্থাপন করতেন সে জায়গাই রাজধানীতে পরিণত হত। রাজ্যের পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেনাবাহিনীর মত পরিচালিত হত, প্রশাসন সেনাবাহিনীর সঙ্গে অভিযানে যোগ দিত। জটিল শিবির সংস্কৃতি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে। প্রধান দুটো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল: বিশ্ব শাসন আর শাসক রাজবংশের স্থায়িত্ব নিশ্চিতকরণ, যে জন্যে সবরকম নিষ্ঠুরতাই বৈধ। এই আদর্শের সঙ্গে প্রাচীন অ্যাবসোলিউটিস্ট পলিটির সাদৃশ্য আছে, যেখানে বিশ্বাস করা হত যে শাসনকর্তার ক্ষমতা যত বেশী হবে রাজ্যের শান্তি আর নিরাপত্তাও তত দৃঢ় হবে। কোনও রাজবংশের সকল সম্রাটের জারি করা আদেশ পরিবার যতদিন ক্ষমতাসীন থাকত ততদিন কার্যকর বলে বিবেচিত হত, ফলে অন্য সব আইনগত ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ত। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সকল দায়িত্ব পরিবারের সদস্য আর স্থানীয় ক্লায়েন্ট ও আশ্রিতদের মাঝে বণ্টন করা হত, যাদের সবাইকে রাজ্যের কেন্দ্রে বিশাল যাযাবর বাহিনীর অনুগামীতে পরিণত করা হত।