ইসলামের এই ধরন হাসান আল-বাসরি বা শাফীর কাছে অচেনা ঠেকত। নিজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুহ্রাওয়ার্দির মৃত্যুদণ্ড হতে পারত, কিন্তু ধার্মিক মুসলিম ছিলেন তিনি, অতীতের যেকোনও ফায়লাসুফের তুলনায় অনেক বেশী কুরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তাঁর রচনা আজও অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্রুপদী সাহিত্য হিসাবে পঠিত হয়ে থাকে। একই রকম পঠিত হয় দ্রুতপ্রজ এবং প্রবল প্রভাবশালী স্প্যানিশ থিয়োসফার মুঈদ আদ-দিন ইবন আল-আরাবিব (মৃত্যু: ১২৪০) গ্রন্থসমূহ। আল- আরাবিও মুসলিমদের নিজের মাঝে আলম আল-মিথাল অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বরকে পাওয়ার উপায় সৃজনশীল কল্পনার (Creative Imagination) মাঝে নিহিত। ইবন আল-আরাবির গ্রন্থসমূহ সহজপাঠ্য নয়, কিন্তু অধিকতর মননশীলদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করেছে; তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, যে কেউই সুফি হতে পারে এবং সবারই উচিত ঐশী গ্রন্থের প্রতীকী, গুপ্ত অর্থের সন্ধান করা। মুসলিমদের দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের কল্পনাকে শাণিত করার মাধ্যমে উপরিতলের অভ্যন্তরে সর্বত্র এবং সর্বজনে বিরাজমান পবিত্র সত্তাকে দেখে নিজস্ব থিয়োফ্যানি সৃষ্টি করা। প্রতিটি মানুষই অনন্য এবং ঈশ্বরের কোনও না কোনও গুপ্ত গুণাবলীর অপুনরাবৃত্তিযোগ্য উন্মোচন এবং আমাদের সত্তার গভীরতম প্রদেশে খোদিত স্বর্গীয় নাম দিয়েই আমরা ঈশ্বরকে জানতে পারব। ব্যক্তিগত প্রভুর ( Personal Lord) দর্শন ব্যক্তির জন্মগত ধর্মবিশ্বাসের শর্তাধীন। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদীকে সকল ধর্মবিশ্বাসকে সম বৈধভাবে দেখতে হবে এবং তাকে সিনাগগ, মসজিদ, গির্জা বা মন্দিরে সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে হবে, যেমন কুরানে ঈশ্বর বলেছেন: “আর যেদিকেই তুমি মুখ ফেরাও, সেদিকই আল্লাহ্র দিক।”[২]
এভাবে খেলাফতের বিলোপের পর এক ধর্মীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এতে করে সাধারণ শিল্পী এবং অভিজাত বুদ্ধিজীবীগণ সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। একটি প্রকৃত মুসলিম জাতি অস্তিত্ববান হয়ে উঠেছিল, যারা ধর্মকে গভীর স্তরে মেনে নিতে শিখেছিল। মুসলিমরা এক ব্যাপক আধ্যাত্মিক নবজাগরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতি সাড়া দিয়েছিল যা নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে ধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে। ইসলাম এসময় রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়াই বিকশিত হচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষেই রাজনৈতিক পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটাই কেবল অপরিবর্তনীয়।
ক্রুসেডসমূহ
একাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সেলজুক তুর্কিদের সাম্রাজ্যের পতন ঘটতে শুরু করলেও তাদের অধীনে বিকাশ লাভ করা রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত আমিরদের ব্যবস্থা টিকে ছিল। এব্যবস্থার সুস্পষ্ট ঘাটতি ছিল। আমিরগণ অবিরাম পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন, ফলে বহিস্থঃ কোনও শত্রুর মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারতেন না কিছুতেই। এ ব্যাপারটি দুঃখজনকভাবে জুলাই ১০৯৯-তে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, যখন পশ্চিম ইউরোপ থেকে আগত ক্রিশ্চান ক্রুসেডাররা মক্কা ও মদীনার পর মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করে, এখানকার অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং প্যালেস্টাইন, লেবানন ও আনাতোলিয়ায় রাষ্ট্র স্থাপন করে তারা। সেলজুক সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখ অবস্থায় পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত অঞ্চলের আমিরগণ ঐক্যবদ্ধ পাল্টা আঘাত হানতে পরেননি। আগ্রাসী পশ্চিমা অনুপ্রবেশের বিরুেদ্ধে তাদের অসহায় বলে মনে হয়েছে। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যাবার পর মসুল ও আলেপ্পোর আমির ইমাদ আদ-দিন যাঙ্গি ১১৪৪-এ আর্মেনিয়া থেকে ক্রুসেডারদের বিতারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং আরও প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল অতিক্রান্ত হবার পর পশ্চিমে সালাদিন নামে খ্যাত কুর্দিশ সেনাপতি ইউসুফ ইবন আইয়ুব সালাহ্ আদ-দিন ১১৮৭-তে ক্রুসেডারদের দখল থেকে জেরুজালেম ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, ক্রুসেডাররা অবশ্য ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ অবধি নিকট প্রাচ্যে উপকূলবর্তী একটা অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই বহিস্থঃ হুমকির কারণে সালাদিন প্রতিষ্ঠিত আইয়ুবীয় রাজবংশ ফার্টাইল ক্রিসেন্টের আমির শাসিত স্বল্পায়ু রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে বেশী দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। অভিযানের প্রাথমিক পর্যায়ে সালাদিন মিশরের ফাতিমীয় রাজবংশকে পরাজিত করে এর এলাকাকে নিজের ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেন এবং অধিবাসীদের সুন্নি ইসলামে ফিরিয়ে আনেন।
ক্রুসেডসমূহ ন্যাক্কারজনক হলেও পাশ্চাত্য ইতিহাসের ক্ষেত্রে গঠনমূলক ঘটনা ছিল; এগুলো নিকট প্রাচ্যের মুসলিমদের পক্ষে বিপর্যয়কর ছিল বটে, কিন্তু ইরাক, ইরান, মধ্য এশিয়া, মালয়, আফগানিস্তান এবং ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জন্যে ছিল সুদূর কোনও সীমান্ত সংঘর্ষের মত। একেবারে বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য অধিকতর শক্তিশালী ও হুমকিতে পরিণত হবার পরেই কেবল মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মধ্যযুগের ক্রুসেডসমূহের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছেন, বিজয়ী সালাদিনের কথা স্মরণ করে নস্টালজিয়াগ্রস্ত হয়ে তেমনি এক নেতার আকাঙ্ক্ষা করেছেন, যিনি পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদের নব্য ক্রুসেড প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন।
সম্প্রসারণ
ক্রুসেডের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ১০৭০-এ ফাতিমীয়দের কাছ থেকে সেলজুকদের সিরিয়া দখলের ঘটনা। এই অভিযানকালে দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রুগ্ন বাইযানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল তারা। সেলজুকরা যখন সীমান্ত অতিক্রম করে আনাতোলিয়ায় পা রাখে, ১০৭১-এ মানযিকুর্টের যুদ্ধে তারা বাইযানটাইনদের শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে। এক দশক সময়কালের মধ্যেই তুর্কি যাযাবররা সমগ্র আনাতোলিয়ায় তাদের পশুপাল নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর আমিরগণ ছোট ছোট রাষ্ট্রের পত্তন করেন যেগুলোর পরিচালনায় ছিল মুসলিমরা, যারা আনাতোলিয়াকে নতুন সীমান্ত আর সম্ভাবনাময় দেশ বলে মনে করেছিল। তুর্কিদের এই অগ্রযাত্রা প্রতিরোধের ক্ষমতাহীন বাইযানটাইন সম্রাট প্রথম আলেক্সাস কমনেনাস ১০৯১তে পোপের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। আবেদনে সাড়া দিয়ে পোপ দ্বিতীয় আরবান প্রথম ক্রুসেডের আহ্বান জানান। অনাতোলিয়ার অংশবিশেষ ক্রুসেডাররা অধিকার করলেও তাতে করে তুর্কিদের ঐ অঞ্চলে অগ্রাভিযান রুদ্ধ হয়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ তুর্কিরা ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় পৌঁছে যায়; চতুর্দশ শতাব্দীতে তারা এজিয়ান সাগর অতিক্রম করে; বলকান এলাকায় বসতি গড়ে তোলে এবং পৌঁছে যায় দানিউব অবধি। অতীতে কখনও কোনও মুসলিম শাসক বাইযানটিয়ামকে এত শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করতে পারেনি, এই সাম্রাজ্যটির প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সম্মানজনক ইতিহাসের পটভূমি ছিল। সুতরাং অহঙ্কার বশতই তুর্কিরা আনাতোলিয়ায় তাদের নতুন রাষ্ট্রটিকে “রাম” (Rum) বা রোম নামে অভিহিত করেছিল। খেলাফতের পতন সত্ত্বেও মুসলিমরা এবার এমন দুটি এলাকায় সম্প্রসারিত হল যা কখনওই দার-আল-ইসলামের অংশ ছিল না –পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটা অংশ- এবং যে এলাকাটি অদূর ভবিষ্যতে অত্যন্ত সৃজনশীল অঞ্চলে পরিণত হয়।