নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের ভিন্ন ধর্মীয় সমাধানের প্রয়োজন সে সম্পর্কে সজাগ ছিলেন আল-গাযযালি। একজন নিষ্পাপ ইমামের প্রতি ইসমায়েলিদের অগাধ ভক্তি অপছন্দ ছিল তাঁর: কোথায় আছেন এই ইমাম? সাধারণ মানুষ কীভাবে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করবে? একজন কর্তৃত্বময় ব্যক্তিত্বের ওপর এই নির্ভরশীলতাকে কুরানের সাম্যবাদের লঙ্ঘন বলে মনে হয়েছে তাঁর। ফালসাফাঁকে তিনি গণিত আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের মত শাস্ত্রের জন্যে অপরিহার্য হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু যুক্তি প্রয়োগের অতীত আধ্যাত্মিক বিষয়াবলী সম্পর্কে এটা নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশ দিতে পারে না। আল-গাযযালির দৃষ্টিতে সুফিবাদই সমাধান, কারণ এর অনুশীলন ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে। প্রাথমিককালে উলেমাগণ সুফিবাদ সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন এবং একে বিপজ্জনক প্রান্তিক আন্দোলন হিসাবে দেখেছেন। আল-গাযযালি এবার ধর্মীয় পণ্ডিতদের সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীদের উদ্ভাবিত ধ্যানের আচারগুলো পালন এবং শরিয়াহ্র বাহ্যিক নিয়মাচারের প্রচারণার পাশাপাশি এই অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিকতায়ও উৎসাহিত করার আহ্বান জানালেন। ইসলামের জন্যে উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে আল-গাযালি অতীন্দ্রিয়বাদকে সোচ্চার স্বীকৃতি দিয়েছেন, নিজের কর্তৃত্ব আর মর্যাদা ব্যবহার করে মুসলিম জীবনের মূলধারায় এর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছেন।
আপন সময়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন আল-গাযযালি। এই সময়ে সুফিবাদ জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, এটা আর সংখ্যালঘুদের মাঝে সীমিত থাকেনি। এ পর্যায়ে অতীতের মত জনগণের ধার্মিকতা উম্মাহর রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জাড়িত না থাকায় তারা অতীন্দ্রিয়বাদীর ইতিহাস নিরপেক্ষ, কিংবদন্তীর অভ্যন্তরীণ অভিযাত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। গূঢ় বিদ্যার্থী মুসলিমদের একান্ত অনুশীলনের পরিবর্তে জিকর (dhikr)– ঐশী নাম জপ– দলীয় চর্চায় পরিণত হয়, যা মুসলিমদের পিরের নির্দেশনায় চেতনার বিকল্প স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। সুফিরা তাদের দুর্জ্জেয়ের সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সঙ্গীত শুনত। পিরের চারপাশে জমায়েত হত তারা, শিয়ারা যেমন এককালে ইমামদের ঘিরে থাকত, তাঁকে ঈশ্বরের পথে পরিচালক হিসাবে দেখত। যখন কোনও পির পরলোকগমন করতেন, কার্যত: একজন “সাধু” (“Saint”)তে পরিণত হতেন তিনি- পবিত্রতার কেন্দ্রবিন্দু– আর লোকে তাঁর সমাধিতে প্রার্থনা আর জিকর অনুষ্ঠান করত। প্রত্যেক শহরে এসময় মসজিদ বা মাদ্রাসার মত আলাদা খানকাহ্ (আশ্রম) ছিল, যেখানে স্থানীয় পির তাঁর অনুসারীদের নির্দেশনা দান করতেন। নতুন নতুন সুফি পদ্ধতি (ত্বরিকাহ্) গড়ে ওঠে, যেগুলো নির্দিষ্ট কোনও এলাকায় সীমিত না থেকে সমগ্র দার আল-ইসলামে শাখা বিস্তার করে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছিল। এসব ত্বরিকাহ্ এভাবে বিকন্দ্রীয়ায়িত সাম্রাজ্যের ঐক্য বজায় রাখার আরেকটা উপায়ে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন শহরের কারুশিল্পী এবং বণিকদের জন্যে নতুন ভ্রাতৃসংঘ আর সমিতি (ফুতুওয়াহ্- futuuwah) গুলোও একই উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল, যেগুলো প্রবলভাবে সুফি আদর্শে প্রভাবিত ছিল। ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোই ক্রমবর্ধমানহারে সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রাখছিল এবং একই সময়ে একেবারে অশিক্ষিতদের ধর্ম বিশ্বাসও এক ধরনের অভ্যন্তরীণ অনুরণন লাভ করেছিল, যা এক সময় কেবল অভিজাত এবং বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর করায়ত্ত ছিল।
এরপর আর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গভীরভাবে সংমিশ্রিত নয় এমন ধর্মতাত্ত্বিক বা দার্শনিক আলোচনার অস্তিত্ব থাকেনি। নতুন “থিয়োসফাররা” (Theosophers) এই নয়া মুসলিম সিনথেসিসের প্রচার করেন। আলেপ্পোয় ইয়াহিয়া সুহ্রাওয়ার্দি (মৃত্যু: ১১৯১) প্রাচীন প্রাক ইসলামী ইরানি অতীন্দ্রিয়বাদের ওপর ভিত্তি করে আলোকনের (আল-ইশরাক) নতুন মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃত দর্শনকে তিনি ফালসাফার মাধ্যমে মননের সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ এবং সুফিবাদের মাধ্যমে হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন, এ দুয়ের মিশেলের ফলাফল হিসাবে দেখেছেন। যুক্তি এবং অতীন্দ্রিয়বাদকে অবশ্যই হাত ধরাধরি করে এগোতে হবে; মানুষের জন্যে উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্যের অনুসন্ধানে উভয়ের প্রয়োজন রয়েছে। অতীন্দ্রিয়বাদীদের দর্শন (Vision) এবং কুরানের প্রতীকসমূহ (যেমন স্বর্গ, নরক ও শেষ বিচার) অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমাণ করা যাবে না; বরং ধ্যানীর প্রশিক্ষিত সজ্ঞামূলক গুণাবলী দিয়ে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। অতীন্দ্রিয় মাত্রার বাইরে ধর্মের কিংবদন্তী কোনও অর্থ বহন করে না, কেননা সেগুলো আমাদের স্বাভাবিক সচেতনতা দিয়ে অনুভূত জাগতিক ঘটনাবলীর মত “বাস্তব” (“real”) নয়। একজন অতীন্দ্রিয়বাদী নারী বা পুরুষ নিজেকে সুফি অনুশীলনের মাধ্যমে জাগতিক অস্তিত্বের অভ্যন্তরীণ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করার জন্যে প্রশিক্ষিত করে তোলে। মুসলিমদের আলম আল-মিথালের– “খাঁটি প্রতিবিম্বের জগৎ” (the world of pure images )– অনুভূতি গড়ে তুলতে হয়, যা নশ্বর জগৎ আর ঈশ্বরের মাঝে বিরাজমান। এমনকি যারা প্রশিক্ষিত অতীন্দ্রিয়বাদী নয় তারাও নিদ্রিত অবস্থায় বা ঘোরে থাকার সময় স্বপ্ন বা হিপনোগোগিক ইমেজারিতে এই জগৎ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে। সুহরাওয়ার্দি বিশ্বাস করতেন, যখন কোনও পয়গম্বর বা অতীন্দ্রিয়বাদী কিছু প্রত্যক্ষ করেন (vision), তিনি অন্তস্থঃ জগৎ সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠেন, যা আজকের দিনে আমরা যাকে অবচেতন মন বলি তার অনুরূপ।