সুতরাং মুহাম্মদ(স:) মক্কার আনুমানিক ২৫০ মাইল উত্তরে অবস্থিত কৃষিভিত্তিক বসতি ইয়াসরিব থেকে আগত গোত্রপ্রধানদের বক্তব্য শুনতে প্রস্তুত হলেন। বেশ কয়েকটি গোত্র যাযাবর জীবন ত্যাগ করে বসতি গড়েছিল সেখানে, কিন্তু মরুপ্রান্ত রের কয়েক শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ বিগ্রহের পর শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। গোটা বসতি একের পর এক ভয়ঙ্কর বিবাদে জড়িয়ে পড়ছিল। এসব গোত্রের কোনও কোনওটি জুডাইজমে দীক্ষা নিয়েছিল কিংবা ইহুদি বংশোদ্ভূত ছিল। সুতরাং, ইয়াসবিরের জনগণ একেশ্বরবাদী ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিল, তারা প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদের প্রতি অনুরুক্ত ছিল না; এছাড়া, একটা নতুন সমাধান পেতে মরিয়া হয়ে ছিল তারা যাতে তাদের জাতি একটি মাত্র গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে একসঙ্গে বাস করতে পারে। ৬২০ এর হজ্জের সময় ইয়াসরিব থেকে আগত প্রতিনিধিদল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং মুসলিমদের সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়: উভয়পক্ষ শপথ নেয় যে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে পরস্পরকে রক্ষা করবে। পরবর্তীকালে, ৬২২-এ মুসলিম পরিবারগুলো একে একে পালিয়ে ইয়াসরিবে অভিবাসন (হিজরা) করে। নতুন আশ্রয়দাতা সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করায় মুহাম্মদ(স:) প্রাণ হারাতে হারাতে আবু বকরকে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
হিজরা থেকে মুসলিমদের বর্ষ গণনা শুরু হয়েছে, কারণ এই পর্যায়ে এসে মুহাম্মদ(স:) কুরানের আদর্শ পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নে সক্ষম হন এবং ইসলাম ইতিহাসের একটা উপাদানে পরিণত হয়। এটা ছিল এক বিপ্লবী পদক্ষেপ। হিজরা কেবল ঠিকানা পরিবর্তন ছিল না। প্রাক-ইসলামী আরবে গোত্রের পবিত্র মূল্য ছিল। রক্ত-সম্পর্কিতদের ত্যাগ করে অন্য গোত্রে যোগদানের কথা ছিল অশ্রুতপূর্ব; এটা আবশ্যকীয়ভাবেই ব্লাসফেমাস কর্মকাণ্ড এবং কুরাইশরা এই পক্ষত্যগ ক্ষমা করতে পারেনি। তারা ইয়াসরিবের উম্মাহকে নিশ্চিহ্ন করার শপথ নেয়। মুহাম্মদ(স:) রক্ত নয় বরং আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া গোত্রীয় দলের প্রধান হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আরবীয় সমাজে যা ছিল এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। কুরানের ধর্ম গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হয়নি, কিন্তু মুসলিম, পৌত্তলিক এবং ইহুদিদের সকলে একমাত্র উম্মাহর সদস্য ছিল, পরস্পরকে আক্রমণ করতে পারত না তারা, পরস্পরকে আশ্রয় দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। এই অসাধারণ নতুন “অতিগোত্রে”র (Supertribe) সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে এবং যদিও গোড়ার দিকে এটা টিকে থাকবে বলে মনে করেনি কেউ, কিন্তু এটা একটা অনুপ্রেরণা বলে প্রমাণিত হয়েছে যা হিজরার দশ বছর পর, ৬৩২- এ পয়গম্বরের পরলোকগমনের আগে আরবে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল।
ইয়াসরিব মদীনা (নগরী) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, কারণ এটা প্রকৃত মুসলিম সমাজের আদর্শ রূপ ধারন করে। মদীনায় পৌঁছার পর মুহাম্মদের(স:) প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল একটা সাধারণ মসজিদ (আক্ষরিক অর্থে সেজদার স্থান) নির্মাণ করা। একটা কর্কশ ভবন ছিল এটা যা প্রাথমিক ইসলামী আদর্শের কৃচ্ছ্রতা প্রকাশ করে। গাছের কাণ্ডের ওপর বসানো হয়েছিল ছাদ, একটা পাথর খণ্ড কিবলাহ্ (প্রার্থনার দিক) নির্দেশ করত এবং ধর্ম প্রচারের জন্য একটা গাছের গুঁড়িতে দাঁড়াতেন পয়গম্বর। ভবিষ্যতের সকল মসজিদ যতদূর সম্ভব এই মডেল অনুসারে নির্মিত হয়েছে। একটা উঠানও ছিল, যেখানে মুসলিমরা উম্মাহর সকল সমস্যা-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক, ধর্মীয়- নিয়ে আলোচনায় মিলিত হত। উঠানের সীমান্তে ছোট ছোট কুটিরে বাস করতেন মুহাম্মদ(স:) এবং তাঁর স্ত্রীগণ। ক্রিশ্চান চার্চের বিপরীতে, যা জাগতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যা কেবল উপাসানার জন্যই নিবেদিত, মসজিদে কোনও কিছুই নিষিদ্ধ ছিল না। কুরানের দর্শনে পবিত্র-অপবিত্র, ধর্মীয়-রাজনৈতিক, যৌনতা-উপাসনার মাঝে কোনও বিভাজন নেই। সমগ্র জীবনই মূলত: পবিত্র এবং স্বর্গের চৌহদ্দির মধ্যে আনতে হয়েছিল তাকে। লক্ষ্য ছিল তাওহীদ (একক করা), গোটা জীবনকে একটি একীভূত গোষ্ঠীতে পরিণত করা, যা মুসলিমদের একত্বের অর্থাৎ ঈশ্বরের সংবাদ দেবে।
মুহাম্মদের(স:) অসংখ্য স্ত্রী পাশ্চাত্যে যথেষ্ট বিকৃত কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে, কিন্তু পয়গম্বর ইন্দ্রিয় সুখে নিমজ্জিত ছিলেন কল্পনা করা ভুল হবে, যেমনটি পরবর্তী কালের কিছু ইসলামী শাসক হয়েছিলেন। মক্কায় একগামী ছিলেন মুহাম্মদ(সঃ), কেবল খাদিজাকে বিয়ে করেছিলেন, যদিও বহুগামিতা আরবে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। খাদিজা বয়সে তাঁর চেয়ে অনেক বড় ছিলেন, কিন্তু তাঁকে অন্তত ছ’টি সন্তান উপহার দিয়েছেন তিনি, যাদের মধ্যে মাত্র চারজন কন্যা জীবিত ছিলেন। মদীনায় মুহাম্মদ(স:) একজন মহান সায়ীদ (প্রধান)-এ পরিণত হন, তাঁর একটা বিশাল হারেম থাকবে বলে প্রত্যাশিত ছিল সবার, কিন্তু এসব বিয়ের অধিকাংশই ছিল রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত। নিজস্ব অতিগোত্র গঠন করার সময় তিনি তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন, যাতে তাদের আরও কাছাকাছি আনা যায়। তাঁর প্রিয়তমা নতুন স্ত্রী আয়েশা ছিলেন আবু বকরের মেয়ে; তিনি উমর ইবন আল-খাত্তাবের মেয়ে হাফসাকেও বিয়ে করেছিলেন। নিজের দুই মেয়েকে তিনি উসমান ইবন আফফান এবং আলী ইবন আবি তালিবের সঙ্গে বিয়ে দেন। তাঁর অপরাপর স্ত্রীদের বেশীরভাগই ছিলেন বয়স্কা নারী, যাদের আশ্রয়দাতা ছিল না বা যা সেইসব গোত্রের প্রধানদের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন যে গোত্রগুলো উম্মাহর মিত্রে পরিণত হয়েছিল। তাঁদের কেউই পয়গম্বরের কোনও সন্তান ধারন করেননি।[১০] তাঁর স্ত্রীগণ মাঝে মাঝে আনন্দের চেয়ে বরং সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একবার যখন তাঁরা এক হামলার পর লুণ্ঠিত মাল বণ্টন নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছিলেন, পয়গম্বর তাঁদের সবাইকে ত্যাগ করার হুমকি দিয়েছিলেন, যদি না তাঁরা কঠোরভাবে ইসলামী মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনযাপন করেন।[১১] কিন্তু তারপরেও একথা সত্যি যে মুহাম্মদ (স:) ছিলেন সেইসব বিরল মানুষদের একজন যাঁরা প্রকৃতই নারীসঙ্গ উপভোগ করেন। তাঁর পুরুষ সহচরদের কেউ কেউ স্ত্রীদের প্রতি তাঁর কোমল আচরণ আর যেভাবে তাঁরা তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাল্টা জবাব দিতেন, দেখে বিস্মিত হয়েছেন। মুহাম্মদ(স: ) সুবিবেচকের মত তাঁদের কাজ-কর্মে সাহায্য করতেন, নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন তিনি এবং স্ত্রীদের সঙ্গ খুঁজে বেড়াতেন। প্রায়ই স্ত্রীদের কাউকে না কাউকে নিয়ে অভিযানে বের বের হতেন তিনি, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন, তাঁদের পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন। একবার তাঁর সবচেয়ে বুদ্ধিমতী স্ত্রী উম্ম সালামাহ্ এক বিদ্রোহ ঠেকাতে সাহায্য করেছিলেন।