যদিও ১০১০-এ স্পেনে উমাঈয়াহ্ খেলাফত শেষ পর্যন্ত ভেঙে গিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিদ্বন্দ্বী স্বাধীন রাজদরবার সৃষ্টি হয়েছিল, তথাপি কর্ডোভাও এক সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ প্রত্যক্ষ করে। স্প্যানিশ রেনেসাঁ বিশেষভাবে এর কাব্যসাহিত্যে জন্যে বেশী খ্যাতি লাভ করে যা ফরাসি ট্রোবাডোর কোর্টলি ঐতিহ্যের অনুরূপ। মুসলিম কবি ইবন হাযাম (৯৯৪-১০৬৪) অপেক্ষাকৃত সরল ধার্মিকতার উদ্ভাবন করেন, যা কেবল আহাদিসের ওর নির্ভরশীল এবং জটিল ফিক্হ্, ম্যাটাফিজিক্যাল দর্শন পরিত্যাগ করেছিল। এসব সত্ত্বেও স্পেনের শেষ পর্যায়ের তারকা বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম ছিলেন ফায়লাসুফ আবু আল-ওয়ালিদ আহমাদ ইবন রূশদ (১১২৬-৯৮), যিনি মুসলিম বিশ্বে সুফিবাদের প্রতি অনুরক্ত ইবন সিনার তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর যুক্তিনির্ভর ধ্যান-ধারণা মায়মোনাইডস (Maimonides), টমাস অ্যাকুইনাস (Thomas Aquinas) এবং (Albert the Great) অ্যালবার্ট দ্য গ্রেটের মত ইহুদি ও ক্রিশ্চান দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছিল। নবম শতাব্দীতে ফিলোলজিস্ট আর্নেস্ট রেনান (Ernest Renan) ইবন রূশদকে (পাশ্চাত্যে অ্যাভেরোস নামে খ্যাত) মুক্ত মনের অধিকারী বলে প্রশংসা করেছিলেন, অন্ধ বিশ্বাসের বিরোধিতাকারী যুক্তিবাদের আদি পতাকাবাহী ছিলেন ইনি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইবন রূশদ ধার্মিক মুসলিম ছিলেন, শরিয়াহ্ আইনের কাজিও। ইবন সিনার মত তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধর্ম ও ফয়ালসুফদের মাঝে কোনও বিরোধ নেই, কিন্তু ধর্ম যেখানে সর্বজনীন, একমাত্র মননশীল সংখ্যাঘরিষ্ঠেরই উচিত দর্শনের দিকে যাওয়া।
মনে হয় যেন খেলাফত- সকল বাস্তব দিক থেকেই- পরিত্যক্ত হওয়ার পর ইসলাম নতুন করে প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছিল। চরম রাজতন্ত্র আর কুরানের আদর্শের মাঝে একটা টানাপোড়েন সবসময়ই ছিল। ইসলামী বিশ্বে ক্রমপ্রয়াসের ভেতর দিয়ে আবির্ভূত নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের অনেক কাছাকাছি ছিল। এমন নয় যে সকল নতুন শাসকই ধার্মিক মুসলিম ছিলেন–বরং উল্টো –কিন্তু স্বাধীন রাজদরবার এবং শাসকবৃন্দের ব্যবস্থা- সবাই সমমর্যাদার কিন্তু এক শিথিল জাতীয় ঐক্যের অধীন- কুরানের সাম্যবাদী চেতনার অনেক নিকটবর্তী ছিল। এটা সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বে বিকাশমান শিল্পকলার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। অ্যাবারাস্ক কোনও একটি হরফকে অন্য হরফের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয় না, প্রত্যেকটা হরফের নিজস্ব অবস্থান রয়েছে এবং তা সমগ্রে নিজস্ব আলাদা অবদান রাখে। ইবন ইসহাক এবং আবু জাফর আল-তাবারি (মৃত্যু: ৯৩২)র মত মুসলিম ঐতিহাসিকগণ পয়গম্বরের জীবনের কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী বিবরণের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের খুব একটা প্রয়াস পাননি, বরং পরস্পর বিরোধী বিবরণ পাশাপাশি উল্লেখ করে গেছেন, সমান গুরুত্ব দিয়ে। উম্মাহর ঐক্যের নিশ্চয়তা দেয়ার কারণেই মুসলিমরা খেলাফতকে মেনে নিয়েছিল; কিন্তু যেই খলিফারা দেখালেন যে তাঁদের দ্বারা আর সাম্রাজ্যকে সংহত রাখা সম্ভব নয়, তখন তাঁরা তাদের প্রতীকী মর্যাদায় নামিয়ে এনে সন্তোষ বোধ করল। ইসলামী ধার্মিকতায় একটা পরিবর্তন এসেছিল। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি রাজনৈতিক সাড়ার মাঝেই থিয়োলজি ও আধ্যাত্মিকার মূল নিহিত ছিল। কিন্তু এবার মুসলিমরা আরও অনুকূল রাজনৈতিক ব্যবস্থা লাভ করায়, মুসলিম চিন্তা আর ভক্তি চলমান ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা আগের মত চালিত হচ্ছিল না। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, আধুনিক কালে ইসলাম অধিকতর রাজনৈতিক হয়ে পড়েছে, যখন মুসলিমরা নতুন নতুন বিপদের মোকাবিলা করেছে, যা উম্মাহর সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় কল্যাণকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে তাদের এবং এমনকি অস্তিত্বকেই হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে।
পরিকল্পিত নয় বরং কাকতালীয়ভাবেই সেলজুক তুর্করা ফার্টাইল ক্রিসেন্টে (Firtile Crescent) নতুন ব্যবস্থার পর পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছিল। বিকেন্দ্রীকরণ অনেক বেশী অগ্রসর ছিল এখানে। সেলজুকরা ছিল সুন্নী, সুফিবাদের প্রতি জোরাল ঝোঁক ছিল তাদের। ১০৬৩ থেকে ১০৯২ পর্যন্ত তীক্ষ্ণধী পারসিয়ান উযির নিযামুলমুলক কর্তৃক তাদের সাম্রাজ্য শাসিত হয়, যিনি সাম্রাজ্যের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে পুরনো আব্বাসীয় আমলাতন্ত্রের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে তুর্কিদের কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাগদাদকে পুনরুজ্জীবিত করার সময় আর ছিল না, কেননা এর অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষিপ্রধান এলাকা সোয়াদ অপরিবর্তনীয় অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল। সেলজুক সেনাদেরও সামাল দিতে পারেননি নিযামুলমুলক। যাযাবর গোষ্ঠীর এক অশ্বারোহী বাহিনী ছিল এরা, যেখানে ইচ্ছা তাদের পাল নিয়ে হাজির হত তারা। কিন্তু নতুন দাস-বাহিনীর সহায়তায় নিযামুলমুলক এমন এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন যার সীমানা দক্ষিণে ইয়েমেন আর পুবে সির-ওক্সাস বেসিন এবং পশ্চিমে সিরিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই নতুন সেলজুক সাম্রাজ্যের খুব বেশী আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না, স্থানীয় পর্যায়ে আমির এবং উলেমাগণ আদেশ কার্যকর করতেন, যাঁরা অস্থায়ী অংশীদারী গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আমিরগণ নিযামুলমুলকের কেন্দ্রীকরণ পরিকল্পনায় বাদ সেধে কার্যত: স্বাধীনভাবে যার যার এলাকা শাসন করতে থাকেন এবং বাগদাদের পরিবর্তে অধিবাসীদের কাছ থেকে সরাসরি ভূমিকর আদায় করতে থাকেন। সামন্ত বাদী ব্যবস্থা ছিল না এটা, কারণ উযিরের ইচ্ছা যাই থাকুক না কেন আমিরগণ খলিফাহ্ বা সেলজুক সুলতান মালিকশা সামন্ত ছিলেন না। আমিরগণ যাযাবর ছিলেন বলে তাদের এলাকায় চাষাবাদ করার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ ছিল না, সুতরাং ভূমি সংশ্লিষ্ট সামন্ত ধাঁচের কোনও অভিজাতন্ত্র গড়ে তোলেননি তাঁরা। তাঁরা সৈনিক ছিলেন, তাই প্রজাদের নাগরিক জীবনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না, যা কার্যত: উলেমাদের এলাকায় পরিণত হয়।