নবম ও দশম শতাব্দীর মুসলিমরা মদিনার প্রথম অবরুদ্ধ ক্ষুদ্র উম্মাহর চেয়ে বহুদূর অগ্রসর হয়েছিল। তাদের দর্শন, ফিক্হ এবং অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলনের মূলে ছিল কুরান এবং প্রাণপ্রিয় পয়গম্বরের চরিত্র, কিন্তু ঐশীগ্রন্থ যেহেতু ঈশ্বরের বাণী, এটা মনে করা হয়েছে যে এর অসংখ্যরূপে ব্যাখ্যায়িত হওয়ার ক্ষমতা আছে। এভাবে তারা প্রত্যাদেশকে এমন এক পৃথিবীর মুসলিমদের কাছে অর্থময় করে তুলেছে যার কথা হয়ত পয়গম্বর এবং রাশিদুন কল্পনাই করেননি। কিন্তু একটা বিষয় অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে। একেবারে গোড়ার উম্মাহর ধর্মের মত ইসলামের দর্শন, আইন এবং আধ্যাত্মিকতা গভীরভাবে রাজনৈতিক। মুসলিমরা- প্রশংসনীয়ভাবেই- গভীর সচেতন ছিল যে, সব উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অর্জন সত্ত্বেও তাদের সৃষ্ট সাম্রাজ্য কুরানের নির্দেশিত মানদণ্ড অনুযায়ী চলেনি। খলিফাহ্ উম্মাহর নেতা, কিন্তু তিনি এমনভাবে জীবন কাটিয়েছেন এবং শাসন করেছেন যা হয়ত পয়গম্বরকে শঙ্কিত করে তুলত। যখনই কুরানের আদর্শের সঙ্গে চলমান রাজনীতির উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতি দেখা গেছে, মুসলিমরা মনে করেছে তাদের সবচেয়ে পবিত্র মূল্যবোধ লঙ্ঘিত হয়েছে। উম্মাহ্ রাজনৈতিক স্বাস্থ্য তাদের সত্তার গভীরতম সত্তা স্পর্শ করতে পারে। দশম শতাব্দীর অধিকতর চিন্তাশীল মুসলিমরা বুঝতে পেরেছিল খেলাফত সঙ্কটাপন্ন, কিন্তু খেলাফত ইসলামের চেতনা থেকে এত দূরবর্তী ছিল যে মুসলিমরা এর পতনকে এক ধরনের মুক্তি হিসাবেই অনুভব করেছে।
তথ্যসূত্র
১. কুরান ৪৯:১২।
২. কুরান ৯:১০৬-৭।
৩. প্রাথমিক শিয়াদের সম্পর্কে খুব বেশী জানা নেই। আমরা নিশ্চিত করে জানি না যে সত্যিই আলীর পুরুষ বংশধরগণ অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়া শিয়াহদের দ্বারা শ্রদ্ধেয় ছিলেন নাকি বংশধারা লুপ্ত হয়ে যাবার পর এবং যখন “দ্বাদশবাদী শিয়া”(“Twelver”) মতবাদ সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে তখন ইতিহাসকে পেছনে আদি ইমামদের প্রতি প্রক্ষেপ করা হয়েছে।
৪. কুরান ২:২৩৪; ৮:২;২৩:৫৭-৬১।
৫. “সপ্তবাদী” (“Sevener”) বা ইসামায়েলি শিয়াবাদের উদ্ভব অস্পষ্ট। ইসমায়েলি অবস্থানের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যে দ্বাদশবাদী শিয়াবাদ-এর থিওলজি গড়ে ওঠার পর ইমাম ইসমায়েলের প্রতি গোত্রীয় আনুগত্যের কাহিনী গড়ে উঠতে পারে। সাধারণত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সপ্তবাদীরা “যায়দীয়” হয়ে থাকতে পারে, অর্থাৎ যেসব শিয়া পঞ্চম ইমামের ভাই যায়েদ ইবন আলীর পথ অনুসরণ করত এবং বিশ্বাস করত যে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মুসলিমদের কর্তব্য।
৩. তুঙ্গ অবস্থা
৩. তুঙ্গ অবস্থা
এক নয়া ব্যবস্থা (৯৩৫-১২৫৮)
দশম শতাব্দী নাগাদ এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে অখণ্ড রাজনৈতিক একক হিসাবে ইসলামী বিশ্ব আর কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে পারবে না। খলিফাহ্ উম্মাহর নামমাত্র প্রধান হিসাবে ছিলেন এবং প্রতীকী ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বজায় রেখেছেন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়েছে। মিশর থেকে ইসমায়েলি ফাতেমীয়দের’ বিচ্ছিন্ন খেলাফত উত্তর আফ্রিকা, সিরিয়া, আরবের সিংহভাগ অঞ্চল এবং প্যালেস্টাইন শাসন করেছে; ইরাক, ইরান এবং মধ্য এশিয়ায় তুর্কি সেনা অফিসারগণ (আমির) ক্ষমতা দখল করে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন রাজ্যসমূহের প্রতিষ্ঠা করেন, যেগুলোর পরস্পরের সঙ্গে সামরিকভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। দশম শতাব্দীকে শিয়া-শতক হিসাবে অভিহিত করা হয়, কারণ এসব রাজবংশের অনেকগুলোরই শিয়াদের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঝোঁক ছিল। কিন্তু আমিরদের সকলেই আব্বাসীয় খলিফাঁকে উম্মাহর সর্বাধিনায়ক হিসাবে স্বীকার করা অব্যাহত রাখেন, একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের আদর্শ এমনই সুরক্ষিত ছিল। এসব রাজবংশ কিছু মাত্রায় রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছিল। একটা এমনকি একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে স্থায়ী মুসলিম ঘাঁটি স্থাপনেও সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ১০৫৫-তে নিম্ন সির (Syr) বেসিন হতে আগত সেলজুক তুর্করা বাগদাদে ক্ষমতা দখল করে খলিফার সঙ্গে বিশেষ চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউই দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারেনি। খলিফাহ্ তাদের সমগ্র দার আল-ইসলামে তাঁর সহকারী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সেলজুকদের বিজয় অর্জনের পূর্ববর্তী বছরগুলোয় এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যেন সাম্রাজ্য চিরদিনের জন্য ছিন্নভিন্ন হতে চলেছে। একটি রাজবংশ যেভাবে অপরটির স্থান দখল করছিল আর যেভাবে বদলে যাচ্ছিল সীমান্ত, একজন বহিরাগত পর্যবেক্ষকের এমন ধারণা করা অযৌক্তিক হত না যে, এক স্বল্পস্থায়ী প্রাথমিক সাফল্যের পর ইসলামী বিশ্ব পতনোন্মুখ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এমন ধারণা হত ভুল। প্রকৃতপক্ষে, প্রায় দুর্ঘটাক্রমেই এক নতুন ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটছিল যা মুসলিম চেতনার অনেক কাছাকাছি হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ইসলামী ধর্ম ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের আলাদা রাজধানী ছিল বলে কেবল বাগদাদে একটিমাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবর্তে একাধিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ফাতিমীয়দের অধীনে কায়রো শিল্পকলা ও জ্ঞানার্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। এখানে দর্শন বিকাশ লাভ করে এবং দশম শতাব্দীতে খলিফাগণ আল-আযহার মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন, যা একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। সমরকন্দেও পারসিয়ান সাহিত্য রেনেসাঁ সংগঠিত হয়। এ পর্যায়ের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন ফায়লাসুফ আবু আলী ইবন সিনা (৯৮০-১০৩৭), পাশ্চাত্যে যিনি আভিসেনা নামে খ্যাত। ইবন সিনা ছিলেন আল-ফারাবির অনুসারী, কিন্তু ধর্মকে অনেক বেশী গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর চোখে একজন পয়গম্বর হলেন আদর্শ দার্শনিক, সাধারণ জনগণের কাছে বিমূর্ত যৌক্তিক সত্যের বাহকমাত্র নন, কেননা তাঁর এমন অন্তর্দৃষ্টির কাছে পৌঁছার ক্ষমতা ছিল যা এলোমেলো সামঞ্জস্যহীন চিন্তা-ভাবনার ওপর নির্ভরশীল নয়। ইবন সিনা সুফিবাদে আগ্রহী ছিলেন এবং স্বীকার করতেন যে অতীন্দ্রিয়বাদীরা অলৌকিকের এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় যা সম্ভব নয়, তবে ফায়লাসুফদের ধারণার সঙ্গে যার সামঞ্জস্য রয়েছে। সুতরাং, ফায়লাসুফ ও অতীন্দ্রিয়বাদীদের বিশ্বাস আর প্রচলিত মতে ধার্মিকদের মাঝে ঐক্যতান রয়েছে।