সমগ্র বিশ্ব এবং প্রধান প্রধান ধর্মীয় ট্র্যাডিশনে এই ধরনের অভ্যন্তরীণ যাত্রার যোগ্যতার অধিকারী নারী এবং পুরুষ এমন নির্দিষ্ট কিছু কৌশল আবিষ্কার করেছে যা তাদের অবচেতন মনের গভীরে প্রবেশে সক্ষম করে তোলে এবং এমন অনুভূতি যোগায় যাকে তাদের সত্তার গভীরস্থ কোনও সত্তা বলে মনে হয়। ছন্দোময় ভঙ্গিতে গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণের সময় মানসিক শক্তি একত্রিত করতে শেখে সুফিরা; তারা উপবাস করে, রাত্রি জাগরণ করে এবং মন্ত্রের মত কুরানে প্রদত্ত ঈশ্বরের গুণসূচক নাম উচ্চারণ করে চলে। মাঝে মাঝে তারা একধরনের বুনো, সীমাহীন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়, এই অতীন্দ্রিয়বাদীরা “মাতাল সুফি” (“drunken sufis”) হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এধরনের সুফিদের প্রথম দিকের একজন হলেন আবু ইয়াযিদ আল-বিস্তামি (মৃত্যু: ৮৭৪), যিনি আল্লাহকে একজন প্রেমিকের মত মিনতি জানিয়েছেন। তবে তিনি ফানাহ্র (বিলীন) কৌশলও শিখেছিলেন: আস্তে আস্তে অহমবোধের সমস্ত স্তর (যা, সকল অধ্যাত্মিক লেখক একমত পোষণ করেছেন, ঐশী উপলব্ধি থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রাখে) খসিয়ে ফেলার মাধ্যমে আল-বিস্তামি আপন সত্তার (being) ভিত্তিভূমিতে এক বর্ধিত সত্তার (Self) সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন যা স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ নন, যিনি বিস্তামিকে বলেছেন; “তোমার মাধ্যমেই আমি; তুমি ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই।” শাহাদায় সম্ভাব্য আঘাত সৃষ্টিকারী এই পুনর্বিন্যাস এক গভীর সত্য প্রকাশ করে, যা অন্য বহু ট্র্যাডিশনের অতীন্দ্রিয়বাদীরাও আবিষ্কার করেছে। শাহাদা ঘোষণা দেয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর, কোনও সত্তা নেই, সুতরাং এটা সত্যি হতে বাধ্য যে যখন সত্তা ইসলামের নিখুঁত কাজের মাধ্যমে নাকচ হয়ে যায়, তখন সকল মানুষই কার্যত: স্বর্গীয়। হুসেইন আল-মনসুর (মৃত্যু: ৯২২) যিনি আল-হাল্লাজ বা উল-কারডার নামেও পরিচিত, একই রকম ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন: “আনা আল-হাক্ক।” (“আমিই সত্য!” বা “আমিই বাস্তব!”), যদিও কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে এটা হওয়া উচিত: “আমি সত্য দেখছি!”
বাড়িতে অবস্থান করেই আত্মার মাধ্যমে বৈধ হজ্জ করা সম্ভব দাবী করার কারণে উলেমাদের হাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন হাল্লাজ। তাঁর মৃত্যু সুফি এবং উলেমাদের মাঝে ক্রমবর্ধমান বৈরিতারই পরিচায়ক। বাগদাদের যুনায়েদ (মৃত্যু: ৯১০) যিনি ছিলেন প্রথম তথাকথিত “স্থির সুফি” (“Sober Sufi”), এই জাতীয় চরমপন্থা থেকে সরে আসেন। তিনি মনে করেছেন, বিস্তামির অনুভূত উন্মাদনা একটা পর্যায় মাত্র, সত্তার বর্ধিত উপলব্ধি এবং আরও পূর্ণাঙ্গ আত্ম-নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অতীন্দ্রিয়বাদীকে যা অতিক্রম করে যেতেই হবে। একজন সুফি যখন প্রথম ঐশী আহ্বান শুনতে পায়, সে নারী বা পুরুষ যেই হোক, অস্তিত্বের সকল উৎসের সঙ্গে কষ্টকর বিচ্ছেদ সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। অতীন্দ্রিয় যাত্রা মানুষের জন্য যা একেবারেই স্বাভাবিক সেখানে ফিরে যাওয়া মাত্র। এই মতবাদ বুদ্ধদের অনুসৃত মতবাদের অনুরূপ। আব্বাসীয় আমলে সুফিবাদ প্রান্তিক আন্দোলন ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে সুফি সাধকরা জুনায়েদের পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে এক গূঢ় আন্দোলন গড়ে তোলে যা আমাদের আলোচিত অন্যান্য আন্দোলনের বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের আকৃষ্ট করেছিল।
নিজেদের যদিও তারা ধার্মিক, নিবেদিত মুসলিম বলে দাবী করেছিল, কিন্তু গূঢ় তাত্ত্বিকরা সবাই পয়গম্বরের ধর্মকে বদলে ফেলেছে। ফায়লাসুফদের মতবাদ শুনলে মুহাম্মদ(স:) হয়ত হতবাক হয়ে যেতেন এবং আলী নির্ঘাত তাঁর দলের লোক বলে ঘোষণাদানকারী শিয়াদের ধারণা ও কিংবদন্তী বুঝতেই পারতেন না। কিন্তু যেকোনও ট্র্যাডিশনের অধিকাংশ বিশ্বাসীর দৃঢ় বিশ্বাস সত্ত্বেও, যারা মনে করে যে ধর্ম কখনও বদলায় না এবং তাদের বিশ্বাস ও আচরণ ধর্ম প্রবর্তকদের অনুরূপ, টিকে থাকার স্বার্থেই ধর্মকে পরিবর্তিত হতে হয়। মুসলিম সংস্কারকগণ ইসলামের অতীন্দ্রিয়বাদী ধরনকে নির্ভরযোগ্য নয় বলে আবিষ্কার করেছেন এবং পরবর্তীকালের সংযোজনে বিকৃত হবার আগের প্রথম উম্মাহ্ নিখাঁদ অবস্থায় ফিরে যাবার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু সময়ের স্রোতের উল্টোদিকে কখনও যাওয়া যায় না। যেকোনও “সংস্কার,” এর উদ্দেশ্য যত রক্ষণশীলই হোক না কেন, সব সময়ই তা নতুন বিচ্যুতি এবং সংস্কারকের আপন সময়ের নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহের সঙ্গে ধর্ম বিশ্বাসের অভিযোজন। যদি কোনও ট্র্যাডিশনের মাঝে বিকাশ ও বৃদ্ধির অবকাশ না থাকে, তা বিলুপ্ত হবে। ইসলাম প্রমাণ করেছে যে এর সেই সৃজনশীল ক্ষমতা রয়েছে। পয়গম্বরের হতাশ নিষ্ঠুর আমল হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে বসবাসকারী নারী এবং পুরুষের মাঝে এক গভীর স্তরে এটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তারা কুরানের শব্দের আক্ষরিক অর্থের অতীত অর্থ দেখতে পায় যা মূল প্রত্যাদেশের পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে যায়। কুরান তাদের জীবনে একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছে যা তাদের পবিত্রতার অনুভূতি যোগায় এবং প্রবল শক্তি আর অন্তর্দৃষ্টির নতুন আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে সক্ষম করে তোলে।