ইয়াকুব ইবন ইসহাক আল-কিন্দি (মৃত্যু: ৮৭০) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের প্রথম প্রধান ফায়লাসুফ বা “দার্শনিক”। কুফা জন্ম গ্রহণকারী আল-কিন্দি বসরা পড়াশোনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত বাগদাদে স্থায়ী হন। সেখানে তিনি আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। রাজধানীতে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে মুতাযিলাদের সঙ্গে তাদের ধর্মত্ত্বকে (কালাম) মানবীয় গুণাবলী হতে মুক্ত করার প্রয়াসে যোগ দিয়েছেন কিন্তু নিজেকে তাদের মত মুসলিম উৎসগুলোর কাছে সীমাবদ্ধ করে ফেলেননি, বরং গ্রিক সাধুদের কাছ থেকেও জ্ঞান অন্বেষণ করেছেন। এভাবে তিনি “আদি কারণে র (First Cause) সপক্ষে অ্যারিস্টটলের প্রমাণকে কুরানের ঈশ্বরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। পরবর্তীকালের সকল ফায়লাসুফের মত তিনি বিশ্বাস করতেন যে মুসলিমদের সর্বত্র সত্যের সন্ধান করা উচিত, এমনকি যদি তা একেবারে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকেও হয়। ঈশ্বর এবং আত্মা সম্পর্কে কুরানে প্রত্যাদিষ্ট শিক্ষা সম্পূর্ণ দার্শনিক সত্যের প্রতীক যার মাধ্যমে এগুলো সাধারণ মানুষের বোধগম্য– যাদের যৌক্তিক চিন্তাভাবনার যোগ্যতা নেই-হয়ে উঠেছে। সুতরাং বলা হয়ে থাকে প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম “দরিদ্র-ব্যক্তির ফালসাফাহ্”। আল-কিন্দির মত একজন ফায়লাসুফ প্রত্যাদেশকে যুক্তির বশীভূত করতে চাননি বরং ঐশীগ্রন্থের অভ্যন্তরীণ সত্তা দেখতে চেয়েছেন তিনি, অনেকটা শিয়ারা যেভাবে কুরানের বাতিন অর্থ অনুসন্ধান করেছে সেরকম।
অবশ্য তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন সঙ্গীতযন্ত্রবাদকই যুক্তিভিত্তিক দর্শনের ইসলামী ট্র্যাডিশনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবু নাসর আল-ফারাবি (মৃত্যু: ৯৫০ ) দর্শনকে প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের তুলনায় উন্নত বিবেচনার ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশী অগ্রসর হন, ধর্ম তাঁর কাছে নিতান্ত সুবিধাজনক একটা বিষয় এবং স্বাভাবিক সামাজিক প্রয়োজনীয়তায় পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। অবশ্য আল-ফারাবি যেখানে গ্রিক যুক্তিবাদী এবং ক্রিশ্চান দার্শনিকদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন সেটা হল রাজনীতির প্রতি তাঁর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ। তিনি যেন বিশ্বাস করেছিলেন যে ইসলামের বিজয়ের ফলেই প্লেটো আর অ্যারিস্টটল যে যৌক্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখেছিলেন সেটা গঠন করা সম্ভব হয়েছে। ইসলাম এর পূর্বসূরীদের চেয়ে ঢের বেশী যুক্তিভিত্তিক ধর্ম। এর ট্রিনিটি (ত্রিত্ববাদ)র মত কোনও অযৌক্তিক মতবাদ নেই, বরং এখানে আইনের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আল-ফারাবি বিশ্বাস করতেন, সমাজের পথপ্রদর্শক স্বরূপ ইমামদের নিয়ে শিয়া ইসলাম সাধারণ মুসলিমদের যৌক্তিক নীতিমালার ভিত্তিতে একজন দার্শনিক-রাজার শাসনাধীন সমাজে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে সক্ষম। প্লেটো যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে কোনও সু-শৃঙ্খল সমাজের এমন কিছু মতবাদের প্রয়োজন রয়েছে যাকে সাধারণ মানুষ ঐশী অনুপ্রেরণাজাত বলে বিশ্বাস করে। মুহাম্মদ (স:) এমন একটা আইন এনেছেন যেখানে ঐশী শাস্তি স্বরূপ নরকের ব্যবস্থা রয়েছে, যা একজন অজ্ঞ ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রভাবিত করবে যা অধিকতর যৌক্তিক বক্তব্যে সম্ভব নয়। এভাবে ধর্ম রাষ্ট্র বিজ্ঞানেরই একটা শাখা এবং একজন ভাল ফায়লাসুফ দ্বারা এর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ হওয়া প্রয়োজন, যদিও গড়পড়তা মুসলিমের তুলনায় ধর্মের অনেক গভীর পর্যন্ত আলোক করতে পারবে সে।
অবশ্য এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে আল-ফারাবি একজন সক্রিয় (Practising) সুফি ছিলেন। বিভিন্ন গূঢ়বিদ্যা সম্পর্কিত দলগুলোর মাঝে পরস্পরের সঙ্গে অংশতঃ মিলে যাবার প্রবণতা ছিল এবং অধিকতর রক্ষণশীল উলেমাদের চেয়ে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের মাঝে। অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট শিয়া ও ফায়লাসুফরা শিয়া ও সুফিদের মত পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, যাদের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একই রকম। সুন্নী ইসলামের অতীন্দ্রিয় রূপ সুফিবাদ আমাদের আলোচিত অন্যান্য মতবাদের চেয়ে আলাদা। কেননা এটা রাজনীতি প্রবণ দর্শন গড়ে তোলেনি। পরিবর্তে এটা যেন আবার পুরনো ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন করেছে; এবং সুফিরা চলমান ঘটনাবলীর পরিবর্তে নিজেদের সত্তার গভীরে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করেছে। কিন্তু ইসলামের প্রায় সকল ধর্মীয় আন্দোলন অন্তত রাজনৈতিক কোনও দৃষ্টিভঙ্গি হতেই সূচিত হয়, সুফিবাদও তার ব্যতিক্রম ছিল না। উমাঈয়াহ্ আমলে মুসলিম সমাজে দৃষ্ট ক্রমবর্ধমান ইহজাগতিকতা আর বিলাসীতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গড়ে ওঠা তপস্যায় (যুদ) এর শেকড় নিহিত। উম্মাহ্ আদি সমাজে ফিরে যাবার প্রয়াস ছিল এটা যেখানে সকল মুসলিম সমান মর্যাদা নিয়ে বসবাস করেছে। সাধুগণ প্রায়শই এক ধরনের কর্কশ উলের পোশাক পরত (তাসাউফ), দরিদ্রদের মাঝে যার চল ছিল, পয়গম্বর যেমন পরতেন। নবম শতাব্দীর গোড়ার দিকে তাসাউফ (যেখান থেকে আমাদের “সুফি” শব্দটি এসেছে) শব্দটি আব্বাসীয় সমাজে ধীর গতিতে গড়ে ওঠা অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলনের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।
সুফিবাদ সম্ভবত জুরিসগ্রুডেন্সের বিকাশের প্রতিক্রিয়াও ছিল, যাকে কোনও কোনও মুসলিমের কাছে ইসলামকে কতগুলো বাহ্যিক নিয়মকানুনের সেটে পর্যবসিত করার মত ঠেকেছিল। সুফিরা নিজেদের মাঝে সেই মানসিক অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল যার দরুণ মুহাম্মদের (স:) পক্ষে কুরানের প্রত্যাদেশ গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। জুরিস্টদের উসুল আল-ফিক্হ’র নয় বরং তাঁর অন্তরের ইসলামই আইনের মূল ভিত্তি। রাষ্ট্রীয় ইসলামের সহিষ্ণুতা যেখানে কমে আসছিল, কুরানকে একমাত্র বৈধ ঐশীগ্রন্থ এবং মুহাম্মদের(স:) ধর্মকে দেখা হচ্ছিল একমাত্র সত্যি ধর্মবিশ্বাস হিসাবে, সুফিরা সেখানে অন্যান্য ধর্মের অস্তিত্ব মেনে নিয়ে কুরানের মূল চেতনায় ফিরে গেছে। কেউ কেউ, উদাহরণস্বরূপ, বিশেষভাবে জেসাসের প্রতি অনুরক্ত ছিল, তাঁকে আদর্শ সুফি হিসাবে দেখেছে, কেননা তিনি ভালোবাসার গসপেল প্রচার করেছিলেন। অন্যরা এমনকি এমনও মনে করেছে একজন পৌত্তলিক যে পাথরের সামনে প্রণামে নত হচ্ছে সেও আসলে সত্যের (আল-হাক্ব) উপাসনা করছে, যা সকল বস্তুর মাঝে বিরাজমান। উলেমা ও জুরিস্টরা যেখানে ক্রমবর্ধমান হারে প্রত্যাদেশকে পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত মনে করছিলেন, সেখানে শিয়াদের মত সুফিরাও নতুন সত্যের সম্ভাবনার ব্যাপারে ছিল উদার, যা যেকোনও স্থানেই মিলতে পারে, এমনতি অন্য ধর্মীয় ট্র্যাডিশনসমূহেও। কুরান যেখানে কঠোর বিচারক ঈশ্বরের বর্ণনা দিয়েছে, সেখানে মহান মহিলা সাধু রাবিয়াহ্ (মৃত্যু: ৮০১)র মত সুফিরা একজন ভালোবাসার ঈশ্বরের কথা বলেছেন।