সমাজবদ্ধতার আদর্শ ছিল কাবার কাল্টের মূল বিষয়। মক্কা এবং এর আশপাশের সকল এলাকায় সব সময়ের জন্যে সবরকম সহিংসতা নিষিদ্ধ ছিল। কুরাইশদের বাণিজ্যিক সাফল্যের পেছনে এটা ছিল একটা প্রধান উপাদান, কেননা এতে করে প্রতিহিংসামূলক বৈরিতার প্রতিশোধ গ্রহণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে সক্ষম হত আরবরা। হজ্জের সময় তীর্থযাত্রীদের অস্ত্রবহন, বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়া, কোনও পশু, এমনকি কীট-পতঙ্গ হত্যা বা বাঁকা কথা বলার উপরও নিষেধাজ্ঞা থাকত। এসবই উম্মার জন্যে মুহাম্মদের(স:) আদর্শের পক্ষে অনুকূল ছিল। তিনি স্বয়ং উপাসনাগৃহের প্রতি নিবেদিত-প্রাণ ছিলেন, প্রায়ই উমরাহ্ পালন করতেন তিনি এবং কাবাহ্’র পাশে কুরান আবৃত্তি করতেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উপাসনাগৃহটি এক নাবাতিয় দেবী হুবালের উদ্দেশ্যে নিবেদিত ছিল। কাবার চারপাশে ৩৬০টি প্রতিমা সাজানো ছিল, সম্ভবত বছরের দিনগুলোর স্মারক ছিল ওগুলো। কিন্তু মুহাম্মদের(স:) কাল আসতে আসতে ধারণা জন্মে যে কাবাগৃহকে পরমঈশ্বর আল্লাহ্র উপাসনালয় হিসাবে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে আর ব্যাপক বিস্তারি বিশ্বাস ছিল যে আল্লাহ্ই পৌত্তলিকদের পাশাপাশি হজ্জ পালনে আগত বাইযানটাইন সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণকারী একেশ্বরবাদী গোত্রসমূহের উপাস্য। কিন্তু এসব কারণেই মিশনের গোড়ার দিকে মুহাম্মদ(স: ) তখনও মুসলিমদের তখনও মুসলিমদের আহল্ আল-কিতাব-এর পবিত্র নগরী জেরুজালেমের দিকে ফিরে সালাত প্রার্থনায় যোগ দিতে বলেছেন, কাবার সঙ্গে পৌত্তলিকদের সম্পর্ক থাকায় উপাসনাগৃহটিকে পেছনে রেখে দাঁড়াত তারা। এ থেকে তাঁর আরবদের একেশ্বরবাদী পরিবারে নিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পায়।
ছোট আকারের অনুসারী লাভ করেন মুহাম্মদ(স:) এবং এক পর্যায়ে মোটামুটি সত্তরটি পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। প্রথম দিকে মক্কার ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা মুসলিমদের উপেক্ষা করেছিল, কিন্তু ৬১৬ নাগাদ তারা মুহাম্মদের(স:) উপর চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা অভিযোগ তোলে যে মুহাম্মদ(স:) তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম বিশ্বাসকে বিদ্রূপ করছেন এবং তিনি নিঃসন্দেহে একজন প্রতারক, যিনি পয়গম্বরের ভান করছেন মাত্র। তারা বিশেষ করে শেষ বিচারের দিন সম্পর্কে কুরানের বিবরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, একে তারা আদিম এবং যুক্তিবর্জিত বলে নাকচ করে দিয়েছিল। আরবরা পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাসী ছিল না এবং এধরনের “রূপকথা”য়[৮] আমলই দিতে চাইত না। কিন্তু তারা এটা দেখে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল যে কুরানে এই জুডো-ক্রিশ্চান বিশ্বাসটি তাদের গলাকাটা পুঁজিবাদের আঁতে ঘা দিয়ে বসেছে। শেষ বিচারের দিন, আরবদের সতর্ক দেয়া হয়েছে, তাদের গোত্রের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্য কোনও কাজে আসবে না; প্রত্যেককে তার নিজস্ব গুণাগুণের ভিত্তিতে যাচাই করা হবে: কেন তারা দরিদ্রের সেবা করেনি? কেন তারা সম্পদ বণ্টনের বদলে তা পুঞ্জীভূত করেছে? যেসব কুরাইশ নতুন মক্কায় সমৃদ্ধি অর্জন করছিল এধরনের কথাবার্তা তাদের ভাল লাগার কথা নয়, ফলে বিরোধী শক্তি জোরাল হয়ে উঠল আৰু আল-হাকাম (কুরানে যাকে আবু জাহল, “মিথ্যার পিতা” বলা রয়েছে), অসাধারণ তীক্ষ্ণধী ব্যক্তি আবু সুফিয়ান, যিনি একসময় মুহাম্মদের(স:) ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন এবং নিবেদিতপ্রাণ পৌত্তলিক সুহায়েল ইবন আমর এর নেতৃত্বে। এঁরা সবাই তাঁদের পূর্বপুরুষের ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগের ধারণায় অস্বস্তিতে ভুগছিলেন, প্রত্যেকের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী আত্মীয়-স্বজন ছিল: এবং সবার আশঙ্কা ছিল যে মুহাম্মদ (স:) বুঝি মক্কার নেতৃত্ব নিজ হাতে তুলে নেয়ার পরিকল্পনা করছেন। কুরান জোর দিয়ে বলেছে যে মুহাম্মদের(স:) কোনও রাজনৈতিক ভূমিকা নেই, বরং তিনি একজন নাজির, “সতর্ককারী”[৯] মাত্র, কিন্তু যে ব্যক্তিটি আল্লাহ্র কাছ থেকে নির্দেশ লাভের দাবী করছেন, তিনি কতক্ষণ তাদের মত সাধারণ মরণশীলদের শাসন মেনে চলবেন?
দ্রুত অবনতি ঘটে সম্পর্কের। আবু জাহ্ মুহাম্মদের(স:) ক্ল্যানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেন, মুসলিমদের সঙ্গে কুরাইশদের ব্যবসা বা বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। এর মানে ছিল কেউই তাদের কাছে খাদ্য বিক্রি করতে পারবে না। দু’বছর স্থায়ী ছিল অবরোধ, এবং খাদ্যাভাবই হয়ত মুহাম্মদের(স:) প্রাণপ্রিয় স্ত্রী খাদিজার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল আর এর ফলে নির্ঘাৎ কয়েকজন মুসলিম আর্থিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইসলাম গ্রহণকারী ক্রীতদাসরা বিশেষভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল, বেঁধে কড়া রোদে ফেলে রাখা হত তাদের। সবচেয়ে মারাত্মক, ৬১৯-এ অবরোধ উঠে যাওয়ার পর মুহাম্মদের(স:) চাচা এবং আশ্রয়দাতা (ওয়ালি) আবু তালিব মারা যান। মুহাম্মদ (স: ) এতীম ছিলেন, শৈশবেই তাঁর পিতা-মাতা পরলোকগমন করেছিলেন। আরবের কঠোর প্রতিহিংসা-মতবাদ অনুযায়ী হত্যার বদলা নেয়ার মত আশ্রয়দাতা না থাকলে যে কাউকে শাস্তির ভয় ছাড়াই হত্যা করা যেত। মক্কার কোনও চীফটেইনকে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পেতে কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল মুহাম্মদকে(স:)। মক্কায় উম্মাত্র অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ছিল, একটা নতুন সমাধান খুঁজে বের করা হয়ে পড়েছিল অপরিহার্য।